পাহাড়ের কোলে ঘুমানো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর–পশ্চিম পাশে অবস্থিত, ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন। এখানে শায়িত আছেন, বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত মুহাক্কিক আলেমেদ্বীন। যিনি মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের প্রাণপুরুষ হজরতুল আল্লামা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (র.)’র একজন বিশিষ্ট ও সুপ্রসিদ্ধ প্রতিনিধি হিসেবে সমধিক পরিচিত ও সমাদৃত। এ মহান বরেণ্য জ্ঞানতাপসের নাম– আল্লামা সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (র.)। একাধারে তিনি একজন ভাষাবিদ, কবি ও শায়ের, সাহিত্যিক ও কলম সম্রাট, যুক্তিতর্কশাস্ত্রবিদ, ইসলামি আইনবিদ, গ্রন্থ প্রণেতা এবং দার্শনিক। সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (র.)- ১৮৬৬ সালে পৃথিবীতে শুভ আগমন করেন। তাঁর বংশধারা হজরত মাওলা আলী (রাদ্বি.) এবং হজরত মা ফাতেমা (রাদ্বি.)- হয়ে নবী মুহাম্মাদুর রাসূল (দ.)- পর্যন্ত পৌঁছেছে। ‘নাজমে দিল কুশা–ফী মিলাদে মুস্তফা’ গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা সৈয়দ আব্দুল করিম ছিলেন, তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা। মাতা সৈয়দা নাছিমা খাতুন একজন মুক্তাকি ও বিদুষী রমণী। পিতার হাত ধরে সহিহ কুরআন পাঠসহ শরিয়তের নানাবিধ মাসআলা–মাসায়েল শিক্ষা নেন এবং স্থানীয় মক্তব ও মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা শেষ করে চট্টগ্রাম মোহসিনীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে অধ্যয়ন শেষ করে ‘মুফতি’ উপাধিতে ভূষিত হন। হজরত ফরহাদাবাদী (র.)-এর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কারণে সমকালীন আলেম সমাজ তাঁকে– আ’লা হজরত, মুফতিয়ে আ’জম, শায়খুল ইসলাম, ইমামুল মুনাজিরিনসহ নানাবিধ উপাধিতে ভূষিত করেন। ভাষাগত নিপুণতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন অনন্য বহুভাষাবিদ এবং অলঙ্কারশাস্ত্রবিদ। বাংলা, আরবি, ফারসি, উর্দ্দু ভাষায় তিনি একাধিক ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘তোহ্ফাতুল আখ্ইয়ার ফী দাফ্–ই–শারারাতিল আশ্্রার’ গ্রন্থটি আরবি, ফারসি এবং উর্দ্দু ভাষার সংমিশ্রণে এবং কাব্যিক আকারে রচনা করেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম পুঁথি সাহিত্যের অনিন্দ্য নিদর্শন। বহু সাহিত্যিক ও গবেষক তাঁর সাহিত্যকর্মকে পুঁথি সাহিত্য হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হজরত ফরহাদাবাদী (র.)- সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে আউলিয়ায়ে কেরামের প্রতি তাঁর বিশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা কাজ করতো। এজন্য ছাত্রাবস্থায়ও বিভিন্ন অলি–দরবেশের সান্নিধ্য লাভ করতেন এবং বিভিন্ন পীর–বুযুর্গের মাজার শরীফ জিয়ারত করতেন। সংসার জীবনে সন্তানদের নাম সমূহ– ১. সৈয়দা উম্মুল খায়ের, ২. সৈয়দা উম্মুচ্ছফা, সৈয়দ ফয়জুল ইসলাম, সৈয়দা উম্মুত তৈয়বা। ফরহাদাবাদী (র.)- শরিয়তের পূর্ণ জ্ঞান হাসিল করে ইলমে তাসাউফের দীক্ষা নেন, চট্টগ্রামের সুপ্রসিদ্ধ আলেমেদ্বীন, শায়খুল হাদিস, শায়খুল মাশায়েখ, হজরতুল আল্লামা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর কাছ থেকে। যদিও তিনি প্রথমে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের কর্মকাণ্ডকে শরয়ি দৃষ্টিতে অপছন্দ করতেন। কেন তিনি অপছন্দ করতেন? এ বিষয়ে স্বরচিত ‘তাওজিহাতুল বাহিয়্যাহ ফী তারদীদে মা ফিত্তানকি হাতিছ–ছনিয়াহ ফী রদ্দে মুনাজেরাতে ফেনী’ গ্রন্থে স্ববিস্তার আলোচনা করেছেন। যার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে, ‘আমি আমার সম্মানিত মুর্শেদের দরবারে যাওয়ার পূর্বে তাঁর তরিক্বার কর্মকাণ্ডের মুনকের (অস্বীকারকারী) ছিলাম। এজন্য যে, আমার ক্বলবে প্রেমের অর্থ সম্পর্কে ধারণা ছিলো না’। একদা স্বপ্নে মাইজভাণ্ডারী (র.)-এর সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁর ক্বলবে ইশকের জোয়ার উঠে এবং আম্মাজানের মানতকৃত টাকা নিয়ে মাইজভাণ্ডার দরবারের দিকে রওনা হন। আর এদিকে, মাইজভাণ্ডারী (র.)- খাদেমদের বললেন, ‘ফরহাদাবাদের বড় মাওলানা আসতেছে তোমরা তাঁকে তা’জিম করো এবং তাঁর আম্মার প্রেরিত টাকাগুলো নিয়ে আসো। তাঁর আগমনের কথা আর প্রেরিত টাকার অগ্রিম সংবাদের কথা শুনার সাথে সাথে তিনি চিরদিনের জন্য হজরত ক্বেবলা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (র.)-এর কাছে নিজকে সমর্পণ করেন এবং তরিক্বতের বায়’আত নেন। দীর্ঘ রেয়াজতের মাধ্যমে এবং চূড়ান্তভাবে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ (দ.)’র সন্তুষ্টি অর্জন পূর্বক তরিক্বতের খেলাফত লাভে ধন্য হন। এ প্রবন্ধে হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (র.)- সর্ম্পকে দুটো কথা বলে রাখা প্রয়োজন, এ কারণে যে বর্তমান সময়ের অনেক মুহাক্কিক আলেমগণ এ মহান আলেমেদ্বীন সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করে বসেন। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (র.)- কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা শেষ করে ‘ফখরুল মুহাদ্দিসিন’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কিছু সময় শিক্ষকতা করেন। একদিক দিয়ে তিনি ছিলেন, শরিয়তের বিদগ্ধ আলেম। অন্যদিক ছিলেন, তরিক্বতের মশহুর আলেম। সর্বোপরি– ইলমে বেলায়াতের ধারক ও বাহক। মাইজভাণ্ডারী (র.)- কলকাতা অবস্থানকালে গাজীয়ে বালাকোট, শায়খুল হাদিস, হজরতুল আল্লামা শাহ সুফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (র.)-এর অভিভাবকত্বে পড়াশুনা শেষ করেন এবং তাসাউফের প্রাথমিক শিক্ষা নেন। তবে চূড়ান্তভাবে তরিক্বতের বায়’আত ও খেলাফত লাভ করেন, ঢাকা আজিমপুর দায়রা শরীফের পীর সৈয়দ লাক্বীতুল্লাহ (র.)-এর খলিফা আবু শামা সৈয়দ মুুহাম্মদ ছালেহ লাহোরী (র.)-এর কাছ থেকে। ঢাকা আজিমপুর দায়রা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা পীর সুফি সৈয়দ দায়েম (র.)- মোজাদ্দেদিয়া তরিক্বার খেলাফত নেন– চট্টগ্রামের শহর কুতুব, সুফি সৈয়দ আমানত শাহ (র.)-এর কাছ থেকে আর কাদেরিয়া তরিক্বার খেলাফত লাভ করেন, ভারতের সৈয়দ মখদুম মোনেম পাক (র.)-এর কাছ থেকে। সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (র.)-এর সাহিত্যকর্ম সমূহের নাম– ১. দাফি উশ্ শুবহাত, ২. শাওয়াহিদুল ইবতালাত্ ফি তারদীদে মা–ফী–রাফি–উল ইশ্কালাত, ৩. তোহ্ফাতুল আখ্ইয়ার ফী দাফ্–ই–শারারাতিল আশ্্রার, ৪. আত্ তাওজিাতুল বাহিয়্যা ফী তারদীদি মা ফী তানকি হাতিছ–ছনিয়াহ, ৫. রাফিউল গেশাবি ফি তরদীদে মা ফী ইশাআতিল ফতাবী, ৬. গায়তুত্ তাহ্কীক ফী–মা ইয়াতায়াল্লুকু বিহি তালাকুত তা’লীক, ৭. মেরাতুল ফান্নে ফি শরহে মোল্লা হাছান, ৮. আগ্লাতে শামী। যেসব বিষয়ে তিনি পারদর্শী ছিলেন– ১. ইলমে তফসির, ২. ইলমে হাদিস, ৩. ইলমে ফিকাহ, ৪. মানতিক, ৫. বালাগাত, ৫. ফরায়েজ, ৬. ফিলোসফি, ৭. ইলমে তাসাউফ। ভারতের সুপ্রসিদ্ধ আলেমেদ্বীন, মাওলানা আহমদ রেজা খান ব্রেলভী– ফরহাদাবাদী (র.)-এর স্বরচিত ‘আগ্লাতে শামী’ গ্রন্থটি পেয়ে পত্র লিখে বলেছিলেন, ‘আপনার মত এমন বিজ্ঞ জ্ঞানী আমার দরকার’। ইমামে আহলে সুন্নাত শেরে বাংলা, আল্লামা সৈয়দ আজিজুল হক আল–কাদেরী– তাঁর স্বচিত ‘দিওয়ানে আজিজ’ গ্রন্থে ফারহাদাবাদী (র.)-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষত ফরহাদাবাদী (র.) মসলকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের উপর বহু কিতাবাদি রচনা করেছেন। আল্লাহর এ মহান অলিয়ে কামেল ও আধ্যাত্ম জগতের মধ্য আকাশের ধ্রুবতারা ২৭ অগ্রহায়ণ ১৯৪৪ সালে বেছাল লাভ করেন।