বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক সব বক্তব্য অনলাইন থেকে সরানোর জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত রুল শুনানির মধ্যে বাদীপক্ষের এক সম্পূরক আবেদনে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চ গতকাল এ আদেশ দেয়।
এদিকে ওই আদেশের পর হাই কোর্টের এ বেঞ্চের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছেন বিএনপির আইনজীবীরা। এ সময় এজলাস কক্ষে বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল ও বিতণ্ডা শুরু হয়। এ পরিস্থিতি চলে প্রায় আধা ঘণ্টা।
অচলাবস্থার মধ্যে বেঞ্চের দুই বিচারক এক পর্যায়ে এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে যান। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তখন ‘শেইম শেইম’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। হট্টগোলের মধ্যে বিএনপিপন্থি শতাধিক আইনজীবীকে এজলাস কক্ষের বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা যায়। বিপুল সংখ্যক পুলিশও ছিল সেখানে। এদিকে তারেকের বক্তব্য সব অনলাইন থেকে সরাতে হাই কোর্টের আদেশ প্রত্যাখান করেছে বিএনপি। খবর বিডিনিউজের।
রিটকারী পক্ষের আইনজীবী কামরুল ইসলাম বলেন, সকল রকমের গণমাধ্যম থেকে তারেকের সব বক্তব্য সরানোর জন্য বিটিআরসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারেকের কোনো বক্তব্য বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে আর দেখা যাবে না। এ আদেশের পর ওরা উচ্ছৃঙ্খলতা দেখায়। শতাধিক আইনজীবী হট্টগোল করে আদালতের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করতে থাকে।
বেলা আড়াইটায় এজলাসে ফিরে দুই বিচারক আদালতের কার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জ্যেষ্ঠ বিচারকের উদ্দেশ্যে ‘পক্ষপাতমূলক বিচারের’ অভিযোগ তোলেন।
বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ১৫ বছর ধরে পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। এর মধ্যেই তারেকের বিরুদ্ধে পাঁচ মামলায় সাজার রায় এসেছে। সাড়ে আট বছর আগে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তারেককে নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। সেই প্রেক্ষাপটে ‘আইনের দৃষ্টিতে পলাতক’ থাকা অবস্থায় তার বক্তব্য বা বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করে হাই কোর্ট।
আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী লিনার রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি বিচারপতি কাজী রেজা–উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ রুলসহ ওই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেয়।
সম্প্রতি নয়া পল্টনে বিএনপির এক সমাবেশে তারেক রহমানের ভিডিও বক্তব্য প্রচার করা হলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। রিটকারী পক্ষ তখন হাই কোর্টের সেই রুল শুনানির উদ্যোগ নেয়। তারেকের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে হাই কোর্ট রুল জারি করেছিল ওই সময়। রুলে তথ্য ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল। রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে বলে ওই সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায় জানিয়েছিলেন।
চার সপ্তাহের মধ্যে তথ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, বিটিভির মহাপরিচালক, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, একুশে টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও তারেক রহমানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। একইসঙ্গে তারেক রহমানের বিদেশে অবস্থানের ওই সময়ের অবস্থা জানাতে পররাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। পুলিশ মহাপরিদর্শককে তারেকের পাসপোর্টের মেয়াদ জানিয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল, সেজন্য সময় দেওয়া হয়েছিল ৩০ দিন। কিন্তু তারেক রহমানকে এ বিষয়ে নোটিস পাঠানো যায়নি বলে সাড়ে আট বছরেও রুলের ওপর শুনানি শুরু করা যায়নি। নোটিস পাঠাতে গিয়ে দেখা যায়, রিট আবেদনে তারেক রহমানের ঠিকানার এক জায়গায় ‘রোড’ এর জায়গায় ‘রুম’ লেখা হয়েছিল। ভুল থাকায় নোটিস তিনি পাননি। আদালত তখন ঠিকানা সংশোধন করে নোটিস পাঠাতে বলে; একই সঙ্গে ফ্যাঙ বা ই–মেইলেও যে নোটিস পাঠানো যায়, সে কথাও বলে।
এরপর নিয়ম অনুযায়ী তারেকের ঠিকানায় নোটিস পাঠানো হয়। এরপর মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়। গত ২২ আগস্ট রুল শুনানির জন্য কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
অ্যাডভোকেট নাসরিন সিদ্দিকা লিনা রোববার তারেক রহমানের সব বক্তব্য সব মাধ্যম থেকে সরানোর নির্দেশনা চেয়ে একটি সম্পূরক আবেদন করেন। সে বিষয়ে শুনানি করে সোমবার আদেশ দিল আদালত।
প্রত্যাখ্যান বিএনপির : তারেক রহমানের বক্তব্য সব অনলাইন থেকে সরাতে হাই কোর্টের আদেশ প্রত্যাখান করেছে বিএনপি। গতকাল আদেশের পর নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তার অভিযোগ, এটা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণের রায়। তার মনের ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এই রায়ের মধ্য দিয়ে। আদালতের বেঞ্চে যে দুইজন বিচারক, তারা যে আদেশ দিয়েছেন এই আদেশের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী চেতনার যে রায় সেটি দিয়েছেন। আমি এই আদেশের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রত্যাখান করছি দলের পক্ষ থেকে এই অবিচারমূলক রায়ের বিরুদ্ধে। আদালতের এ ধরনের আদেশ ফ্যাসিজমের আরেকটি নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।