তারুণ্যের জয়গানে মুখরিত চারিদিক

নাসের রহমান | বুধবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

সবাই তরুণ্য পছন্দ করে। তারুণ্যের মাঝে থাকতে চায়। তারুণ্যে স্বাচ্ছন্দ খুঁজে পায়। তারুণ্যকে সাথী করে চলার চেষ্টা করে। তারুণ্যের শক্তি অপরিসীম। যে কোনো কাউকে স্বপ্ন দেখাতে পারে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহস যোগাতে পারে। সে সাহস তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারে। স্বপ্ন ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। বাঁচার মত বাঁচতে হলে স্বপ্ন থাকা চাই। অনেক রকম স্বপ্ন। শৈশবের স্বপ্ন, কৈশোরের স্বপ্ন, যৌবনের স্বপ্ন। অনেকে বলে যৌবনের সময়টা শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময়টা স্বপ্ন পূরণের আসল সময়।

আসলে তরুণ্যের স্বপ্নটা সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। তরুণেরা যে স্বপ্ন দেখে তা কি তারুণ্যের স্বপ্ন? শুধু তরুণেরা তারুণ্যের স্বপ্ন দেখে না। যে কোনো বয়সে তারুণ্যের স্বপ্ন দেখা যায়। শিশুকিশোর থেকে শুরু করে যুবক প্রৌঢ়। এমনকি বয়োবৃদ্ধদের মাঝে তারুণ্য লক্ষ্য করা যায়। এদের তারুণ্য অনেক সময় তরুণদেরকেও হার মানায়। তারুণ্য কখনো তরুণদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না। যে কোনো বয়সের যে কোনো কেউ তারুণ্যের সাথে থাকতে পারে। তারুণ্যের স্বপ্নে উদ্ভাসিত হতে থাকে, উজ্জীবিত হতে পারে। তারুণ্যকে কখনো বয়সের ছকে বাধা যায় না। তারুণ্য সবসময় উদ্যম, উচ্ছলতায় ভরপুর থাকলেও তারুণ্যের অন্তর্নিহিত স্বরূপ দৃঢ় মনোবল, শক্তি ও সাহসে পরিপূর্ণ থাকে। এজন্য তারুণ্য কখনো বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে না। কারো কাছে মাথানত করে না। অন্যায়ের কাছে হার মানে না। কখনো মনোবল হারায় না। মনের শক্তিতে এগিয়ে চলে।

তরুণেরা সাধারণত বাধা ধরা নিয়মে চলতে চায় না। জরাজীর্ণ যে কোনো কিছু ভেঙে ফেলতে চায়। প্রচলিত নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করতে চায় না। আবার সহজে ভাঙতেও পারে না। নিয়ম ভাঙা এত সহজ ব্যাপার নয়। কোনো কোনো নিয়ম দীর্ঘ দিন চলতে চলতে অনিয়মে পরিণত হয়ে যায়। এসব অনিয়মকে দূর করতে পারে তরুণেরা। তাদের কাছে অপরিমেয় প্রাণ শক্তি। অসীম সাহসিকতা। শক্তি আর সাহস একত্র হলে এদের আর ঠেকানো যায় না। তরুণেরা সহজে একতাবদ্ধ হতে পারে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। অন্যায় অবিচারকে রুখে দিতে পারে। একুশের ভাষা আন্দোলনে তরুণেরা শুধু প্রতিবাদ করে ক্ষান্ত হয়নি। বুকের রক্ত দিয়ে অন্যায় অবিচারকে থামিয়ে দিয়েছে। নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষা করে সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তরুণদের প্রাণের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে শহীদ মিনারযা বাঙালির প্রেরণার উৎস।

শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির কোথাও আঘাত এলে তরুণেরা সবার আগে এগিয়ে আসে। প্রতিবাদ করে, সোচ্চার হয়। অন্যদের জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। এ তরুণেরা এক সময় বেপরোয়া হয়ে উঠে। এদের আর কেউ থামাতে পারে না। এরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। তারুণের জোয়ারে ভাসে। ভেঙে চুরে চুরমার করে দেয়।

অনেকের ধারণা তরুণেরা উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া। কোনো কিছু মানতে চায় না। যারা এ রকম কিছু বলতে চায় তারাও এক সময় তরুণ ছিল। তখন তারা কী রকম ছিল তা এখন ভাবতে পারে না। সব তরুণ আবার একই রকম হয় না। বিভিন্ন ধরনের তরুণ দেখা যায়। তবে বেশির ভাগ তরুণের স্বভাব অনেকটা কাছাকাছি। তারুণ্যে ভরপুর থাকে। একটা না একটা কিছু মাথায় ঘুরপাক খায়। কোনো একটা কিছু পেলে এর পেছনে ছুটে। একের দেখাদেখি অন্যরাও পিছু নেয়। সব সময় যে ভালো কিছুর পেছনে ছুটে তা নয়। কখনো কখনো বিপজ্জনক কিছু ঘটিয়ে ফেলে। ভাল মন্দ আগে পিছে কিছুই ভাবে না। তখন অনেক মনে করে এরা উচ্ছৃঙ্খল, এরা কারো কথা শুনে না। এমনকি বড়দেরকে সমীহ করে না। যা মন চায় তা করে বসে। এদের উৎপাতে অনেকে মৃয়মান হয়ে থাকে। চুপ করে সহ্য করে যায়।

এসব তারুণ্যের সাথে যদি মানবিকতা যুক্ত করা যায় তাহলে কেমন হয়। তরুণদের মাঝে দেশপ্রেমের বীজ বপন করা যায়। মাতৃভূমির প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা তৈরি করা যায়। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা যায়। হিংসা বিদ্বেষ ভুলে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করা যায়। পরিবারের প্রতি, পাড়া প্রতিবেশির প্রতি, সমাজের প্রতি সব মানুষের ক্ষেত্রে সহনশীল মনোভাব আনতে পারলে তরুণেরা কেমন হবে। শিশুকিশোর আর তরুণেরা কেমন হবে। শিশুকিশোর আর তরুণেরা কোথা থেকে শিখে। এরা কিভাবে বেড়ে উঠে? এরা বড়দের কাছ থেকে শিখে। পরিবার, সমাজ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আর বিদ্যালয় থেকে শিখে। ভালো যা কিছু আছে তার সাথে বৈপরিত্যও তাদের মনে রেখাপাত করে। কৈশোর পেরিয়ে যখন তরুণ বয়সের দিকে যায় তখন এসব বৈপরিত্য তাদেরকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অভাব অনটনের চেয়ে আশেপাশের অসংগতিগুলো তাদের মনকে অস্থির করে তোলে। কোনো কোনো সময় এ অস্থিরতা তারুণ্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। অনেকে তা সহজভাবে নিতে পারে না। তরুণদের তারুণ্যকে দোষারোপ করে।

অথচ যতসব বড় বড় অর্জন সবগুলোতে তরুণেরা অগ্রগামী থেকেছে। তরুণেরা সবার আগে শুরু করে। ভয়ভীতি সব উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়েছে। অন্যায় অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামে সর্বাগ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে কখনো পিছপা হয় না। কখনো আপোষ করেনি। কোথাও মাথানত করেনি। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যত আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে সবগুলোতে তরুণেরা অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। মিছিলে সবার আগে থেকেছে। মৃত্যুকে পরোয়া না করে তারা সম্মুখ পানে এগিয়ে গিয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে মিছিলে রক্তের সিড়ি বেয়ে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। হাজার কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছে। লাখো তরুণ প্রাণ বির্সজন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এনে দিয়েছে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণেরা দুর্বার গতিতে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে এসেছে। তারুণ্যের উচ্ছলতায় তরুণেরা বীরত্বগাথায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। মহান বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। তাই তারুণ্যের সাথে দেশপ্রেম যুক্ত হলে তখন তরুণেরা হয়ে উঠে দুর্জয়, দুর্নিবার। আর মানবিকতার ছোঁয়া পেলে তরুণেরা পরিণত হয়ে যায় অনির্বান শিখায়।

বয়সের সাথে তারুণ্যের নিবিড় সম্পর্ক। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তারুণ্যের ধরনও বদলায়। শিশুকিশোর বয়সে তারুণ্যের যে ছোঁয়া যৌবনে পা দিলে তা যেন নতুন রূপ লাভ করে। পরিপূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করে। তারুণ্যের উজ্জ্বল চেতনায় যৌবন কালটাকে সার্থক করতে চায়। এ সময়টাতে ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায়। সময়টাও খুব দীর্ঘ নয়। কয়েক বছর কাটতে না কাটতে তারুণ্য আর আগের মত উদ্বীপ্ত থাকে না। প্রায় যৌবনের গান থেমে যায়। প্রৌঢ় বয়সটায় বাধা ধরা ছকে জীবন চলতে থাকে। ছকের বাইরে আর আসতে পারে না। তবে অনেকের আবার তারুণ্যের অভিযান কখনো থামে না। তারুণ্যকে নিয়ে তারা বেঁচে থাকতে চায়। বয়সের সাথে তারুণ্য ধারণ করে এগিয়ে চলে। বয়স এদের কখনো আটকে রাখতে পারে না। পঞ্চাশ উর্ধ্ব এমনকি ষাটোর্ধ্ব বয়সের অনেকে তরুণদের মত উদ্বীপ্ত থাকতে পারে। সবার সাথে সহজে মিশে যেতে পারে। অন্যকে আপন করে নিতে পারে। নিজেদের প্রাণবন্ত রাখতে পারে। মনোবলও শক্ত রাখতে পারে। কোনো কিছুতে ভেঙে পড়ে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। পুরানোর সাথে নতুন কিছুকে সহজে গ্রহণ করতে পারে। বৃহত্তর স্বার্থে ভাল কিছুর জন্য কোনো সংস্কার প্রয়োজন হলে তার পক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। তরুণদের কাজ কর্মে উৎসাহ প্রদান করে, প্রেরণা যোগায়। তরুণেরা ঘোরের মাঝে কোনো কিছু করতে চাইলে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করে। তরুণেরা তখন বয়োজ্যেষ্ঠদের তাদের হিতাঙ্খাকী মনে করতে পারে। যে কোনো মহৎ কাজ, বড় কাজ করতে তরুণদের প্রয়োজন হয়। তরুণদের শক্তি অপরিসীম। তারা অনেকটা অকুতোভয় সৈনিকের মত। তরুণেরা সাথে থাকলে যে কোন অর্জন সহজ হয়ে ওঠে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তখনকার তরুণদের জন্য বিজয় অর্জন এত সহজ হয়েছে। তাই এসময়ের তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত রেখে দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ করে এগিয়ে নিতে পারলে আবার তারুণ্যের জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠবে চারিদিক।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলা সাহিত্যের দিকপালদের পদচারণায় মুখরিত চট্টগ্রাম