রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম ফারুয়া ইউনিয়নে একসময় ব্যাপক তামাক চাষ হতো। এখন তামাকের বদলে ফারুয়া ইউনিয়নের রেংখ্যং নদীর দুই পাড়ে ৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শীতকালীন সবজি শিম ও বিভিন্ন সবজি চাষ করে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়েছেন স্থানীয় পাহাড়ি কৃষকরা। লাভের আশায় আগে জমিতে তামাক চাষ করলেও এখন বদলেছে সে দৃশ্যপট। বাণিজ্যিকভাবে শিম ও সবজি চাষ করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি ফারুয়ার রেংখ্যং নদীর তীরে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গিয়েছে, বিলাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে শুরু করে দুর্গম ইউনিয়নের ফারুয়া বাজার পর্যন্ত রেংখ্যং নদীর দুই পাড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে শীতকালীন লতাজাতীয় দেশীয় শিম, ফরাস শিম ও বিভিন্ন প্রকার শাক–সবজি চাষাবাদ হয়েছে। নদীর দুই পাড়ে দিগন্ত জুড়ে শিম চাষের কারণে সবুজের সমারোহ। দৃশ্যত নদীর দুই ধারে কোথাও পতিত জমি খালি নেই। সব স্থানেই সবুজে সবুজে ভরে গেছে শিম আর সবজি চাষে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম ফারুয়া ইউনিয়নে রবি মৌসুমে লতা জাতীয় দেশীয় শিম ৭৫ হেক্টর ও ফরাস শিম ৩০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এছাড়া সবজি ২২৬ হেক্টর, চিনাবাদাম ৬৫ হেক্টর ও ভুট্টা ২৬ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে।
স্থানীয়রা কৃষকরা জানিয়েছেন, ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও কৃষকরা না বুঝে লাভের আশায় ব্যাপক তামাক চাষ করতো। তবে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক জানতে পেরে কৃষকরা শিম ও সবজি চাষের দিকে ঝুঁকেন। এখন নদীর দুই পাড়ে কোথাও তামাক চাষের দেখা মেলে না। এছাড়া শিম ও সবজি একই জায়গায় এক সঙ্গে চাষের পাশাপাশি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণও সম্ভব। ফলে চাষিদের লোকসানের ঝুঁকি নেই। ইতোমধ্যে ফরাস শিম কর্তন শুরু হলেও দেশিয় শিমের ফুল ও ফল আসতে শুরু হয়েছে। একমাস পর শিমের ফলন আসবে বলছেন কৃষকরা। বর্তমানে কৃষকরা ফরাস শিম মণ প্রতি ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। এসব শিম কৃষকরা সরাসরি মাঠে বিক্রি করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের কাছেই।
স্থানীয় কৃষাণী ইনোচিং মারমা বলেন, ফারুয়া এলাকায় শিমসহ তিনি নানান জাতের সবজি চাষ করেছেন। গত বছরের তুলনায় এ বছর ভালো ফলন হয়েছে। আরেক কৃষক গোয়াইনছড়ি এলাকার বিশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা জানান, বর্গায় জমিতে এ বছর ৬০ শতক জমিতে শিম চাষ করেছেন। শিমে যাতে ভালো ফলন পাওয়া যায় তার জন্য ভিটামিন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করেছেন। তার আশা এ বছর ভালো ফলন পাবেন।
বিলাইছড়ির এগুজ্জেছড়ি মৌজা হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) ও কৃষক সমুল্য তঞ্চঙ্গ্যা জানান, ১৯৮০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এ এলাকায় তামাক চাষ করা হতো। এখন তার বদলে শিম, বাদাম ও সবজির চাষ করা হচ্ছে। আমরা ফারুয়া এলাকায় জরিপ করে দেখেছি প্রায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বেশি জমিতে শিম, বাদাম ও সবজি চাষ করা হয়েছে। আমি নিজেই চার একর জমিতে নয় বছর ধরে শিম ও বাদাম চাষ করে আসছি। প্রতি বছর এ চাষ করে ৮ লাখ টাকা আয় হয়। কিন্তু এ বছর প্রায় দুই একর শিম ক্ষেত ইদুরেরা নষ্ট করে দিয়েছে। এজন্য কৃষি অফিসের সহযোগিতা দরকার।
ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ফারুয়া ইউনিয়নের মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। একসময় এখানে প্রচুর তামাক চাষ হতো। টোব্যাকো কোম্পানির লোকজন স্থানীয় লোকজনদের বিনা সুদে ঋণ দিয়ে তামাক চাষ করাতো। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত কৃষকরা আর তামাক চাষ করছেন না। এখন শিম আর চীনা বাদাম চাষ হচ্ছে। আবহাওয়া যদি অনুকূলে থাকে তাহলে এ বছর শিমের ফলন ভালো হবে। যদিও শিমের ফলন পেতে এক থেকে দেড় মাসের সময় লাগতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ তপন কুমার পাল বলেন, ফারুয়ার রেংখ্যং নদীর দুই পাশ যখন বর্ষাকালে পানি বৃদ্ধি পায় তখন প্রচুর পলি জমে। পানি কমে যাওয়ার সাথে এসব চর বা জমিতে শিম ও বাদাম ব্যাপকভাবে চাষ করে কৃষকরা। তাই এ শিম চাষ ফারুয়া এলাকার জন্য বিখ্যাত। একসময় এ ইউনিয়নের ব্যাপক তামাক চাষ হতো। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে শিম ও বাদাম চাষে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সে ধারাবাহিকতা বজায় আছে। যেহেতু জমিতে পলি জমে, তাই জমি উর্বর থাকায় অল্প পরিশ্রমে কৃষকরা ব্যাপক পরিমাণে শীতকালীন শিম উৎপাদন করে থাকেন।