পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসনের পর এবার সেই তামাক শোধনের প্রক্রিয়া চলছে দেদারচে। এই শোধন কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে লাখ লাখ মণ কাঠ। সেই জ্বালানি কাঠের যোগান দিতে গিয়ে বেপরোয়াভাবে উজাড় চলছে কক্সবাজারের চকরিয়ার সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এতে বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড়ের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের কচি গাছপালাও রক্ষা পাচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন অন্তত অর্ধশতাধিক ট্রাক, পিকআপ, ভ্যানে করে তামাক শোধন চুল্লিতে সরবরাহ করা হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ছোট–বড় গাছপালা কেটে তৈরি করা জ্বালানি কাঠ। একেবারে বিনা বাধায় এসব জ্বালানি কাঠবাহী গাড়িগুলো প্রকাশ্যে চলাচল করছে। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের
অধীনস্থ ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন পাঁচটি বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজার করে এসব জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের পর সোজা তামাক শোধন চুল্লিতে সরবরাহ করছে কাঠ পাচারকারী সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছরের মতো এবারও ফসলি জমি দখল করে নিয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক। তামাক আবাদ বন্ধে ইতোপূর্বে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো দিন দিন এখানে তামাকের আগ্রাসন বেড়েছে। আবার মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের
সরকারি খাস জমিতেও ব্যাপকভাবে চাষ হয়েছে তামাকের। আর এসব তামাক শোধনের (কিউরিং) জন্য তৈরি করা হয়েছে হাজারো চুল্লি (তন্দুর)। চুল্লিগুলোতে জ্বালানি হিসেবে প্রতিদিন পুড়ছে বনের কাঠ।
সচেতন মহলের দাবি, সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই তামাকচাষ বন্ধ করা যাবে না। তামাক চাষে পরিবেশ, নিজেরাসহ আশপাশের মানুষের শারীরিক ক্ষতি হলেও কোম্পানিগুলোর লোভ দেখানো ফাঁদে পড়ে তামাক আবাদের দিকেই ঝুঁকছেন চাষিরা। এতে প্রতিবছরই বাড়ছে তামাকের পরিধি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চকরিয়ায় কম করে হলেও প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে এবারও চাষ হয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক। সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের বমু বনবিট ও সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়নের মানিকপুর বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং
উপজেলার মাতামুহুরী নদী তীরের বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর–মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ খাস জমিতে তামাকচাষ চলছে।
জানা গেছে, সরকারি হিসেবে উপজেলায় আগের চেয়ে কম পরিমাণ জমিতে তামাকচাষ করা হচ্ছে বলে কৃষি বিভাগ দাবি করলেও বাস্তবে দেখা গেছে, তামাকচাষের পরিধি গতবছরের চেয়ে চলতি বছর বেড়ে গেছে।
কাকারা ইউনিয়নের বাসিন্দা ফাহিম নোবেল, আকতার মারুফসহ বেশ কয়েকজন পরিবেশসচেতন ব্যক্তি দৈনিক আজাদীকে জানান, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে কাকারা ইউনিয়নসহ উপজেলার অন্তত ১০ ইউনিয়নে তামাকের আগ্রাসন চলছে। যখন এসব তামাক পাতা শোধন করা হয় তখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল
উজাড় করা হয় দেদার। উজাড়ের মাধ্যমে কাঠচোরেরা লাখ লাখ মণ জ্বালানি হিসেবে সরবরাহ করা হয় তামাক চাষিদের। আর এসব কাঠ বিনা বাধায় প্রকাশ্যে গাড়িযোগে আনা হয় তামাক চুল্লিতে। মূলত সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ম্যানেজ করেই সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে থাকেন কাঠচোর সিন্ডিকেটের দল। যোগ করেন তারা।
তামাকচাষের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে জড়িত এনজিও সংস্থা উবিনীগ ও একলাবের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চকরিয়ায় উপজেলায় প্রায় আট হাজার একর জমিতে তামাকচাষ করা হচ্ছে। একই সাথে বনাঞ্চলের আশপাশে ও লোকালয়ে কয়েক হাজার তামাক চুল্লিও নির্মাণ করা হয়। অসংখ্য তামাক কোম্পানি
চাষিদের প্রলোভনে ফেলে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে মাঠে নামিয়েছে। সংস্থা দুটির গবেষণা কর্মকর্তাদের ধারণা, তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় ফাঁদে পড়ে কৃষক প্রায় আট হাজার একর জমিতে এ বছর তামাকের চাষ করেছে। প্রতিবছর তামাকচাষের পরিধি বাড়তে থাকায় উপজেলার আবাদি জমির পরিমাণ
কমে যাচ্ছে। এতে করে চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে খাদ্য উদ্বৃত্ত এ উপজেলায় চরম খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে বলে দাবি করেছেন কৃষি সচেতন মহল।
জানতে চাইলে তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) কঙবাজারের কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, এ বছর চকরিয়া উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে প্রায় আট হাজার একর জমিতে তামাকের আগ্রাসন দেখা গেছে। এর মধ্যে
সংরক্ষিত বনের কিছু অংশ এবং মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাসজমি মিলিয়ে আরো এক হাজার একর জমিতে তামাকের আবাদ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, তামাক চাষের কারণে জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। একই সাথে তামাক শোধন কাজে জ্বালানি কাঠ
ব্যবহার হওয়ায় প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সামাজিক বনায়ন ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানের মূল্যবান বৃক্ষরাজি। তামাকচাষের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় এ উপজেলায় প্রতিবছর কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। এ কারণে রবি শষ্য ও ধান চাষাবাদে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তা।
চকরিয়া পরিবেশ সচেতন একাধিক সাংবাদিক বলেন, তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও মাঠ পর্যায়ের চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক র্যালি, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু প্রশাসনের এই কার্যক্রম এখন তামাক
কোম্পানির দাপটে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে অতীতের মতো এবছরও উপজেলায় বেড়েছে তামাকের আগ্রাসন। পাশাপাশি তামাক শোধনের জন্য চলছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও ব্যক্তি মালিকানাধীন গাছ নিধনের মহোৎসব।
এ ব্যাপারে কঙবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেহরাজ দাবি করেছেন, তার নিয়ন্ত্রণাধীন পাঁচটি বনবিট তথা কাকারা, মানিকপুর, ফাঁসিয়াখালী, নলবিলা ও ডুলাহাজারা বনবিট এলাকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কোনো ধরনের জ্বালানি সংগ্রহের অংশ হিসেবে বনের গাছ কাটতে
দেওয়া হচ্ছে না। তবে তামাক চাষি ও লাকড়ি ব্যবসায়ীরা অন্য এলাকা এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান থেকে এসব জ্বালানি সংগ্রহ করছেন বলে তিনি শুনছেন।