তাদের কাছে জীবনের অর্থ ছিল একেবারে অন্যরকম। কোনোরকমে জীবনটা ধরে রাখাই ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কি করবে, কিভাবে জীবন কাটাবে তা নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত ছিল না। তারা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে, তাদের মতো মানুষের জীবনও মানুষের ভালোবাসায় বর্ণিল হবে। বিয়ে সংসার তো দূরের কথা, ঠিকঠাকভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার আশাও যেখানে ছিল অচেনা, সেখানে জামান হোটেলের পার্টি হলে জমকালো আয়োজনে বিয়ে হয় তাদের। মানুষের ভালোবাসা এবং উপহারে মুগ্ধ হয় তারা। তাদের বিয়েতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকারি কর্মকর্তাসহ গণ্যমান্য অনেকেই।
মারাত্মক রকমের শারীরিক প্রতিবন্ধী সাইরা তাসনিম ও শহীদুল আলম ইমনের বিবর্ণ জীবনে গতকাল এমনই অপ্রত্যাশিত বর্ণিলতা তৈরি হয়। শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীর বদান্যতায় জীবনের ভিন্ন এক রঙের নাগাল পেলো দুই তরুণ তরুণী। নতুন সংসার জীবন শুরু করা সাইরা তাসনিম ও শহীদুল আলম ইমনের কাছে গতকালের দিনটি বর্ণনাতীত স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
সাইরা তাসনিম এবং শহীদুল আলম ইমন দুজনই মারাত্মক রকমের শারীরিক প্রতিবন্ধী। নানা ধরনের জটিলতার পাশাপাশি তাদের শরীরের উচ্চতা অস্বাভাবিক রকমের কম। সাইরার উচ্চতা মাত্র ৩ ফিট ৩ ইঞ্চি, আর ইমনের উচ্চতা ৪ ফিট ৪ ইঞ্চি। ইমন বোয়ালখালীর গোমদন্ডীর মোহাম্মদ শাহ আলমের ছেলে। শারীরিক সমস্যার কারণে তেমন কিছুই করতে পারে না। ২০১৫ সালে এইচএসসি পাশ করলেও দারিদ্রতার কারণে আর এগুতে পারেনি। ইমনের পায়েও রয়েছে সমস্যা। চলাফেরা করতে পারলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। অপরদিকে পূর্ব ষোলশহরের বারইপাড়ার আবদুর রহমানের কন্যা সাইরা তাসনিম হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজে বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার বাবা নেই। মা নানা শারীরিক অসুখে শয্যাশায়ী। সংসারের আয় রোজগারের কেউ না থাকায় অভাব অনটনের পাশাপাশি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকেও পদে পদে কাহিল করে তুলছিল।
কোনো রকমের বেঁচে থাকার একটি অবলম্বনের জন্য গত ২০ জানুয়ারি সাইরা ও ইমন শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরীর চশমাহিলস্থ বাসভবনে গিয়ে দেখা করে। তারা তাদের জীবনের নানা দুঃখ কষ্ট এবং দুর্দশার পাশাপাশি জীবন জীবিকার অনিশ্চয়তার ব্যাপারটিও মন্ত্রীকে জানায়। মন্ত্রী তাদের কথা ধৈর্য্য ধরে শুনেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে এই দুই প্রতিবন্ধীর দায়িত্ব নেন। তিনি নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক তোসাদ্দেক নূর চৌধুরী তপুকে এই দুই তরুণ তরুণীর সার্বিক দেখভালের নির্দেশ প্রদান করেন এবং মন্ত্রীকে সময়ে সময়ে আপডেট দেয়ারও নির্দেশনা দেন। মন্ত্রী সমাজসেবা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে এই দুজনের বেঁচে থাকার জন্য কী কী করা যায় তা ভেবে দেখার নির্দেশ দেন।
সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং মূক ও বধির স্কুলের শিক্ষকেরা যখন তাদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিল তখন তাদের দুজনের বিয়ের ব্যাপারটি সামনে এসে পড়ে। শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে চট্টগ্রাম মূক ও বধির স্কুল ও সমাজ সেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দুই পরিবারের সাথে যোগাযোগ এবং বিয়ে নিয়ে আলোচনা করা হয়। অবশেষে দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ের আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তোসাদ্দেক নূর চৌধুরী তপু গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা এবং সহযোগিতায় তাদের বিয়ের আয়োজন করা হয়। মন্ত্রী তাদের বিয়েতে যেন কোনো কিছুর কমতি না থাকে তার ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেন, নির্দেশনাও দেন। আর মন্ত্রীর নির্দেশনায় আয়োজন করা হয় জমকালো অনুষ্ঠানের। গতকাল দুপুরে নগরীর মুরাদপুরস্থ জামান হোটেলের পার্টি হলে তাদের বিয়ে উপলক্ষে আয়োজিত হয় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে বর কনেকে পার্লার থেকে নান্দনিকভাবে সাজিয়ে আনার পাশাপাশি স্টেজও করা হয়। একটি পুরোদস্তুর বিয়ে অনুষ্ঠানের সব আয়োজনই করা হয় জামান হোটেলে। মাছ মাংসসহ নানা পদে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়।
বর কনে সেজে সাইরা এবং শহীদুল খুশী খুশী মুখ করে সারাক্ষণ অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে। তাদের অভিনন্দন জানাতে আসা সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সাথে কৌশল বিনিময় করেছে। এমন বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল তাদের কাছে অকল্পনীয়। তাদের কাছে পুরো ব্যাপারটি স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে। ৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহরে বিয়ের কাবিননামাও রেজিস্ট্রি হয়েছে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সমাজ সেবা কার্যালয়ের ডিডি ফরিদুল আলম, পিএইচটি সেন্টারের সহকারী পরিচালক কামরুল পালা ভূঁইয়া, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুচ সামাদ, শাহেন শাহ হযরত জিয়াউর হক মাইজভান্ডারী ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক এ ওয়াই এম জাফর, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সমাজসেবা কার্যালয়ের ডিডি মোহাম্মদ ফরিদুল আলম গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, মাননীয় মন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা দুই প্রতিবন্ধীর বিয়ের আয়োজন করেছি। আমরা তাদের কিছু উপহারও দিয়েছি। একটি টমটমও তাদের দেয়া হয়েছে। নতুন সংসার জীবনসহ সামনের দিনগুলোতে তারা যেন কিছুটা ভালো থাকে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।