‘গল্প নয়’ বলে একটি কলাম আজাদীর নারী পাতায় প্রায় এক যুগের বেশী সময় ধরে তিনি লিখেছেন। গভীর ও সংবেদনশীল লেখার কারণে তাঁর রয়েছে গুণমুগ্ধ পাঠক। ইদানীং আর সেভাবে লেখা পাই না। গত ১৬ ডিসেম্বর ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে দু’কথা লিখেছেন কবি, গল্পকার সৈকত দে
‘রেডিওতে এক বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে বলছিলাম বাংলাদেশটা হলো এক ডানামেলা পাখি। সে গা ঝাড়া দিলে যে জলের ফোঁটা তারা হলো ছোটো ছোটো দ্বীপ।’-তাঁর সাথে দীর্ঘ ফোন আলাপের একটা নমুনা তুলে দিলাম। নিত্য নিজের ভাবনাকে নবায়ন করতে পারার ইচ্ছে সবার থাকে না। ২০০৮ সালে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষ আয়োজনে আমাদের তৎকালীন পার্টির কাউকে যখন রাজি করাতে পারলাম না তখন নিজাম ভাই প্রধান দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিলেন। নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। যথাসময়ে আমাদের অধুনালুপ্ত ছোটোকাগজ নাব্যিকের আয়োজনে অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। তিনি সঞ্চালনা করলেন। তখনকার অযান্ত্রিকের হলঘরে অনুষ্ঠানটা হয়েছিলো। সে-ই প্রথম দেখা। সেদিনের বিস্তারিত প্রতিবেদন লিখেছিলেন ‘কথা’-র সম্পাদক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর তাঁর পত্রিকায়।
পাহাড়তলী কলেজের শিক্ষক তিনি, আমাকে অনেকবার বলেছেন সেখানে যেতে। ফাঁকিবাজ ছাত্র বলে সবসময় শিক্ষকদের প্রতি এক অবচেতন ভয় কাজ করেছে তাই যাইনি অনেকদিন। একদিন গেলাম। কলেজটাতে ঢোকার মুখে কৃষ্ণচূড়া গাছ আকাশের নীল ব্যাপ্ত করে আছে। শিক্ষকদের কক্ষে উঁকিঝুঁকি মারতে তিনি দেখতে পেলেন আমায়। পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। লজ্জা লাগছিলো, কেন না তার আগে কেউ আমায় এমন করে চেনায়নি। বেশ খানিকটা সময় ছিলাম। আর তারপর তিনি আমার জীবনে শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। আস্তে আস্তে তাঁর বইগুলো পেতে থাকলাম। একটাই অনুবাদের বই। গোপাল হালদার কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে এক শীর্ণকায় অথচ অপূর্বদৃষ্ট বই লিখেছিলেন, সেই বইটাই তাঁর ইন্টারেস্টিং লাগায় অনুবাদ করে ফেলেন।
প্রথম গল্প বইটা পাইনি । কালো জল সাদা ফেনা। পরের দুটো তিনিই আমায় উপহার দিয়েছেন। যতদিন আছে চন্দ্রসূর্য আর হননসুখ। আমার মাঝে মাঝে দুঃখ লাগে, গল্পনির্মাতা হিসেবে তাঁকে সেভাবে কেউ আবিষ্কার করলো না বলে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকবার বলেছি, একটা নির্বাচিত গল্প সংকলন প্রকাশ করলে খারাপ হতো না। কেননা এই গল্পগুলো আরো কিছু পাঠক দাবি করে, তাদের এইভাবে হারিয়ে যেতে দেয়া বাংলা ভাষার পাঠকের প্রতি ইচ্ছেকৃত অপরাধ।
পরিচয়ের পর থেকেই আজাদীতে তাঁর সাপ্তাহিক কলাম সংকলনের আমি ভক্ত। তাঁর মন খোলা বলেই যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি। একবার, চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন মেলার বছর তাঁকে স্টুডিও থিয়েটারে প্রায় জোর করেই পাঠাই চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের আয়োজনে একটা সিনেমা দেখার জন্যে । পাঠিয়ে আমি মেলার দিকে চলে গেলাম। তিনি পরের সপ্তাহে একটি চমৎকার লেখা লিখলেন ডিপার্চার্স সিনেমাটা নিয়ে। আমার ধারণা, সিনেমা নিয়ে এটাই তাঁর একমাত্র লেখা।
পিতাপুত্রের সম্পর্ক নিয়ে নির্মিত অত্যন্ত সংবেদনসম্পন্ন সিনেমার ভেতরকার বেদনাটুকু কেমন করে তিনি ধরলেন ভেবে এখনো মাঝে মাঝে অবাক হই । কেবল গল্পটা বলে দিয়ে তিনি নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি। নিজেকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি কেন আমি তাঁর পাঠকে পরিণত হলাম। আমার নিজস্ব উত্তর হলো, তিনি তাঁর সকল লেখায় উপস্থিত থাকেন। নিজে উপস্থিত থাকা বলতে আমি বোঝাতে চাই, নিজের আত্মাটুকু লেখার মধ্যে মিশিয়ে দেয়া। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সম্পাদক’ গল্পটি আমি পড়েছিলাম অনেক ছোটোবেলায়। সেই কোন ক্লাস থ্রিতে পড়বার সময় আমাদের শহরের বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের চতুর্থ তলায় হয়েছিলো এক মেলা। সেখান থেকেই দেবসাহিত্য কুটিরের ‘সোনার ঝাঁপি’ গল্প সংকলন। তো, সম্পাদক গল্পে এক স্কুলপড়ুয়ার কথা ছিলো যে ভাবতো, অমরত্ব জিনিসটা আসলে লেখার কালির সাথে মিশিয়ে নিতে হয়। বড় হতে হতে বুঝি, শ্যামল আসলে বিশেষ বিশেষ পত্রিকাগোষ্ঠীর তরফে লেখকদের অমরত্ব ঘোষণাটাকে স্যাটায়ার করছিলেন আর বুঝলাম, অমরতা নয় লেখায় আসলে নিজের যাপন থাকা লাগে। নইলে লেখাটুকু ফাঁপা খোলসে পরিণত হয়। সাময়িক কারণের লেখাতেও তিনি কেমন করে থেকে যান যেন! বিশেষ করে দুটি লেখার কথা বলতে চাই, লেখা দুটি শহীদ সাবের আর মাহমুদুল হক সংক্রান্ত। দুটি লেখা প্রথমে পত্রিকার কলামে প্রকাশিত, পরে বইতে। শেষ দুই বইতে আমি ছিলাম ওতপ্রোতযুক্ত। মারীমুক্ত সে পৃথিবীতে আমার খানিক মন খারাপ হলেই প্রিয় গন্তব্য তাঁর বাসায়। পত্রিকার কর্তিত অংশ নিয়ে আসি নিজের বাসায় বড়ো প্যাকেটে। পড়তে পড়তে সেই সময় স্মৃতিতে ফিরে আসে, পারিবারিক আনন্দ আর বিপর্যয়ের দিন মনে পড়ে। তাঁকে পাশে পাওয়াটুকুও। নাতিদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বেঙ্গল পাবলিকেশন আর জাগৃতি থেকে বেরিয়ে গেলো যথাক্রমে নির্বাচিত নিম প্রবন্ধ আর চর্যার হরিণী তুই।
আরেকটা ঘটনা ঘটেছে তাঁর সাথে পরিচয়ের পর। হাইলি ইন্টারেস্টিং কিছু একসাথে পড়া। যেমন শঙ্খ ঘোষের প্রায় সামপ্রতিক বই পরম বন্ধু প্রদ্যুম্ন আমরা একসাথে পড়লাম। পড়বার পর তাঁর কথা শোনাটা একটা অভিজ্ঞতা। মানুষ খাবার থেকে যে পদ্ধতিতে পুষ্টি পায় ঠিক সে পদ্ধতিতে তিনি পছন্দের বই থেকে প্রাণরস সঞ্চয় করেন। এতো দুরন্ত পাঠক আমার জীবদ্দশায় আর মাত্র একজনই দেখেছি। তিনি আমাদের প্রিয় বড় ভাই, অকালপ্রয়াত নিজাম ভাই। পড়া বলতে আমি বুঝি, পড়বার পর ভাল বই হলে সে-বই সম্পর্কে অন্যকে আগ্রহী করে তোলার ক্ষমতা অর্জন । খারাপ বইকে সম্পর্কের কারণে ভালো বই বলবার নাগরিক লেখকসুলভ অভ্যেস তাঁর নেই । এই করোনায় আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি তাঁর সামনে বসে তাঁর প্রায় অন্য পৃথিবীর রেসিপিতে প্রস্তুত খাবার খেতে-খেতে সাহিত্য আলোচনা করতে না পারা। এই বছরের শুরুর দিকে প্রায় দেড় মাস আমি তীব্র ব্যাক পেইনে ভুগেছিলাম। ঘোড়াউত্রার প্রকাশক সুমন দীপ প্রতিদিন অফিস করে এসে রাতে আমার সাথে অনলাইন আলাপে বসতেন। আদতে তাঁর পরিশ্রমেই আমার গল্পবই বিপ্লব আনবাড়ি যায় প্রকাশিত হলো । উৎসর্গ পত্রের সাদা পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে আমার প্রায় বিশ বছরের গল্পের নির্বাচিত সংকলন আমি কাকে দিতে চাই ভাবতে আমার এক মুহূর্ত লাগেনি। এতো পূর্ণ মানুষ একাধিক দেখার সৌভাগ্য বিরল।
অনেক অনুরোধের পর তাঁর এক পুরনো ডাইরি আমার মালিকানাধীন হয়েছে। অসংখ্য এন্ট্রি। এক জায়গায় এসে থমকে যাই ু নিজেকে বোঝানোর জন্যে সংক্ষিপ্ততম শব্দ তিনি খুঁজে চলেছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। তিনি আমার দিদি । তাঁর
অক্ষরের সন্ততিদের নির্মাণকাল পর্যবেক্ষণ আমার প্রিয়, কারণ শব্দব্যবহারের এই পরিমিতি বিরল। বললে আরো অজস্র পৃষ্ঠা লিখতে পারি। কিন্তু আজ এইটুকু থাক।
আমার দিদি ফেরদৌস আরা আলীমের শতায়ু কামনা করি তাঁর জন্মদিনে । অনেকদিন নতুন লেখা দেখি না। নতুন বছরে লিখবেন আবার? আর অগ্রন্থিত রচনাগুলোর বেলাবেলি একটা ব্যবস্থা করে ফেললে আমরা যারা ভালো লেখা পড়তে চাই তাদের উপকার হতো । বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো সুন্দর মানুষটির সরাসরি ছাত্র হতে না পারার দুঃখ কোনোদিন যাবে না আমার।