সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সমবায় আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমবায় সংগঠনের সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। দেশে অনেক সমবায় সমিতির সফলতা রয়েছে; এগুলো প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সামাজিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমবায়ের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
গতকাল শনিবার সকালে ৫৪তম জাতীয় সমবায় দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম শিশু একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ‘সাম্য ও সমতায়, দেশ গড়বে সমবায়’ প্রতিপাদ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমবায় দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক মোহাম্মদ দুলাল মিঞা। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ ও জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জেলা সমবায় অফিসার মো. মোসলেহ্ উদ্দিন। শুরুতে বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়। এরপর জাতীয় ও সমবায় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিবসের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সভায় চট্টগ্রাম জেলাধীন সাতটি প্রাথমিক সমবায় সমিতিকে তাদের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।
ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনীতি শক্তিশালী করতে তরুণ এবং নারীদের অধিক মাত্রায় সমবায়ে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ৩০ বছরের কম বয়সী। ২০২৪–এর জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই তরুণরাই একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তরুণরা তাদের আত্মপ্রত্যয় ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই তরুণ শক্তিকেই এখন আমাদের সমবায় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। তরুণদের হতাশা ও বেকারত্বের অভিশাপ এই আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়েছে। তরুণদের সম্পৃক্ত করে সমবায়ের মাধ্যমে এই দেশকে এগিয়ে নিতে এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই সুযোগ হাজার বছরেও আর আসবে না। সুতরাং এ বিষয়ে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।
উপদেষ্টা বলেন, নারীদেরও সমবায়ের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। সেই সাথে স্থানীয় পর্যায়ে কৃষক, কারিগর ও নারীদের সম্পৃক্ত করলে স্থানীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হবে এবং জাতীয় উৎপাদনও বাড়বে। বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে যে কেউ সমবায়ে যুক্ত হয়ে উৎপাদন, বিপণন, আত্মসামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সমবায় সংগঠনগুলোকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
ফারুক–ই–আজম বলেন, আমাদের দেশটা অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। এখানে বিপুল সংখ্যক ভূমি অনাবাদী পড়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমি পড়ে আছে চাষ করে না। দেশের অনাবাদি এসব জমি সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদের আওতায় আনার পরামর্শ দেন তিনি।
সমবায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একতাই বল’ এই মূলমন্ত্র আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সেই সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও ত্যাগের মানসিকতা না থাকলে সমবায় অর্থহীন। বিশ্বাস ছাড়া সহযোগিতা হয় না, আস্থা ছাড়া সংগঠন টিকে না, আর ত্যাগ ছাড়া সমবায়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য বিকশিত হয় না। যখন একজন সদস্য নিজের সামান্য স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করেন, তখনই সমবায়ের প্রকৃত শক্তি প্রকাশ পায়। একইভাবে, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এর অর্থ এই যে, প্রতিটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য মানবিকতা। মানবিকতা না থাকলে একজন মানুষ দেশের সুনাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। সমবায় সংগঠনের লাভ–ক্ষতির বিষয়ের চেয়ে পারস্পরিক সহমর্মিতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও সম্মিলিত অগ্রগতির আকাঙ্ক্ষাই মূল প্রতিপাদ্য। সমবায়ের এই চেতনা যদি আমরা আমাদের কর্মে, চিন্তায় ও আচরণে ধারণ করতে পারি, তবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি আমরা সামাজিক ন্যায় ও মর্যাদার এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারব।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ও দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি. এর সভাপতি ওয়াহিদ মালেক, বিভাগীয় সমবায় দপ্তর চট্টগ্রামের উপ–নিবন্ধক মোহাম্মদ মাহবুবুল হক হাজারী, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা ও কানিজ ফাতেমা, সহকারী নিবন্ধক মোহাম্মদ হাসান আল মামুন, শাহাব উদ্দীন ও মুহাম্মদ হাসান এবং চট্টগ্রাম জেলার উপ–সহকারী নিবন্ধক গাজী মু. ওমর ফারুক চৌধুরী, ডবলমুরিং থানা সমবায় অফিসার বিজয় কৃষ্ণ নাথ, পাঁচলাইশ থানা সমবায় অফিসার মমতাজ বেগম ও কোতোয়ালী থানা সমবায় অফিসার মোহাম্মদ ওসমান গণি।
বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দিন বলেন, বর্তমান বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট প্রথা ভেঙে সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা গেলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও বেগবান হবে। সুইজারল্যান্ডের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সমবায়ের মাধ্যমে সেদেশে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কালের পরিক্রমায় এদেশেও সমবায় আন্দোলন বিকশিত হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। তিনি উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ বলেন, সিঙ্গাপুরে প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন অর্থাৎ ১৫ লক্ষ মানুষ সমবায়ের সাথে সম্পর্কিত, যা তাদের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ। আমরা যদি আমাদের দেশের ২৫ শতাংশ মানুষকে বা প্রায় পাঁচ কোটি মানুষকে সমবায় নেটওয়ার্কে আনতে পারতাম, তাহলে বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সেবা পেতাম এবং তারা অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ত না।
বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক মোহাম্মদ দুলাল মিঞা বলেন, বৈষম্য বঞ্চনার সৃষ্টি করে। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও ঘৃণা সৃষ্টি করে। সাম্য ও সমতার ভিত্তিতে সমবায়ভিত্তিক যে–কোনো কাজ করলে সমাজের সকল স্তরের মানুষ সমান সুযোগ ও সুবিধা পায়, বৈষম্য দূর হয় এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ ও ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এর ফলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠিত হয়, যেখানে প্রত্যেকেই নিজেদের দক্ষতা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে।
তিনি বলেন, সমবায় অর্থাৎ সমবায়ের আদর্শ মানুষকে কাছে টেনে নেয়। মানুষে মানুষে দূরত্ব হ্রাস করে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের সোপান হলো সমবায়। কাজেই সমবায়ের নীতি, আদর্শ যদি মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হই, তাহলে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য ও দূরত্ব আছে তা হ্রাস পাবে এবং শান্তি ও সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মাণ হবে।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম কৃষিভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠন করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এ জাতীয় সমিতিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, সমাজে বিরাজমান আয়ের যে বৈষম্য, বণ্টনের যে বৈষম্য, সম্পদের যে বৈষম্য, সেটি দূর করতে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রান্তিক যে সমবায় রয়েছে, এদের যারা সদস্য আছেন তাদেরকে স্কিল বেসড ট্রেনিং দিতে হবে। তাদের প্রপার গাইড করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশে গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে দারিদ্র্য এবং দুর্দশা লাঘবের উদ্দেশ্যে সমবায় কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এটি ছিল পুঁজি গঠন এবং পুঁজি গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য মুক্তির হাতিয়ার।
জেলা সমবায় অফিসার মো. মোসলেহ্ উদ্দিন বলেন, সমবায়ীদের স্ব–কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় রেখে সমবায় অধিদপ্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, নারী উদ্যোক্তা, অনগ্রসর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। বাস্তবায়িত এ সকল প্রকল্পের মাধ্যমে উপকারভোগীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সমিতিগুলো সম্পূর্ণ নিজস্ব মূলধন ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে কৃষি, মৎস্যচাষ, গবাদী পশু ও হাঁস–মুরগি পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, সেলাই প্রশিক্ষণ প্রভৃতি কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমবায়ের অবদান অনস্বীকার্য। আজ গ্রামের সাধারণ মানুষ আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে। এসবের পিছনে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চলুন আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি, সততা, ন্যায়বোধ ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের প্রতিটি সমবায়কে আরো শক্তিশালী করব। আমরা যদি কর্মক্ষেত্রে, সমাজে এবং দৈনন্দিন জীবনে সমবায়ের চেতনাকে ধারণ করতে পারি তাহলে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বৈষম্য কমবে। গড়ে উঠবে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
সভায় সমবায়ীদের পক্ষে বক্তব্য দেন বাকলিয়া মহিলা সমবায় সমিতি লি. এর ব্যবস্থাপক রিনা বেগম, রূপালি ক্রেডিট কো–অপারেটিভ লি. এর সভাপতি আবুল কাশেম, পদ্মা অয়েল এমপ্লয়ীজের সভাপতি আবদুল আজিজ, বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়ীজের পরিচালক মাহফুজুল হক, ইসলামাবাদ টাউন কো–অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি লি. এর সদস্য এবং অবসরপ্রাপ্ত থানা সমবায় অফিসার শহিদুল ইসলাম।
        











