ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরী প্রায়ই বলতেন ‘আমার জীবনের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। কবিতা আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। আনন্দ বেদনায় পরিপূর্ণ জীবনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে । ‘হ্যাঁ, কথাগুলো এতটাই সত্যি যে, তাঁর কবিজীবনে জীবন ঘনিষ্ঠতা এবং বিবেকবোধ তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। সত্যসন্ধানী এবং স্বদেশপ্রীতির বৈশিষ্ট্যমন্ডিত কবিত্বের অবয়ব আসাদ চৌধুরীর মধ্যে বিদ্যমান ছিলো আজীবন। ৫ অক্টোবর কবির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে । তাঁর পুরো নাম ছিল আশেক এ ওয়াসেক মুহাম্মদ আসাদুল ইসলাম চৌধুরী।
‘তবক দেওয়া পান’ আসাদ চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ এর ডিসেম্বরে যখন তাঁর বয়স বত্রিশ। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা অবলোকন করেছেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। বইয়ের নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, লোকজ নির্যাস দিয়ে রচিত এ কাব্যগ্রন্থ। ‘তবক’ এই আরবী শব্দটির অর্থ ‘স্তবক‘। সোনার পাতলা পাত বা নানা রকমের মসলা দিয়ে তৈরি সুগন্ধীযুক্ত পানের নির্যাসের সাথে কবি পরিচিত হয়েছিলেন লোকসংস্কৃতি ও লোকভাষার সুগন্ধি নিয়ে। এ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কবি পিয়াস মজিদ লিখেছিলেন ‘আমরা বলি, এও তার স্মৃতিচর্যারই প্রকাশ। সময়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত যে লোকাচার– লোকাভ্যেস লুপ্তপ্রায়, তাকে স্মৃতিতে জায়মান রাখেন কবি তবক দেওয়া পানের রূপকে। একদিন হয়তো পানের বরজ উঠে যাবে এই দেশ থেকে, একদিন এই তুমুল ফরমালিন বাস্তবতায় প্রাণের ‘পান’ হয়তো নেবে বিষের আকার, তখন আসাদ চৌধুরীর কবিতাসূত্রে ‘পান’ থাকবে আমাদের স্মৃতির গহনে। আর তার কবিতা মনে করিয়ে দেবে অলস দুপুরের বাংলা, একটু আয়েশী ভঙ্গী আর গুরুভার মজলিশে হালকা রসের ফোয়ারা। এই কাব্যগ্রন্থ ৫৩ টি কবিতার আয়োজনে প্রকাশিত। ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ কবিতার ভেতরে দুঃখপূর্ণ আক্ষেপ কবিকে উদ্বেলিত করে, যখন তিনি বলেন ‘নদীর জলে আগুন ছিলো / আগুন ছিলো বৃষ্টিতে, আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার / উদাস করা দৃষ্টিতে/ কুকুর বিড়াল থাবা হাঁকায়/ফোঁসে সাপের ফনা / শিং, কই মাছ রুখে দাঁড়ায় / জ্বলে বালির কণা / এখন এসব স্বপ্ন কথা / দূরের শোনা গল্প/ তখন সত্যি মানুষ ছিলাম / এখন আছি অল্প । ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যে বিদ্রোহ আমাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়েছে, যে আগুন ছিলো জলে, বৃষ্টিতে, যোদ্ধার অন্তরে, একই প্লেটে খাবার খাওয়ার আন্তরিকতা, একই কম্বলের নীচে ঘুমানো, এসব সহাবস্থান তিনি উদাহরণ হিসেবেই কবিতায় প্রকাশ করেছেন। কবি তাই সেই সময়কার জীবনযাপনকে বর্তমান সময়ে এসে মানুষের মতো মানুষ থাকার কথা বলেছেন ।
আসাদ চৌধুরীর কবিসত্তায় ‘উপলব্ধি’ এক বিশাল জায়গা দখল করে আছে। ‘তবক দেওয়া পানের ‘প্রথম কবিতা ‘আমার বাবা’ কবিতায় বাবার ভালোবাসার অভিব্যাক্তি শব্দময় দ্যোতনায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘আমার বাবা বাসতো ভালো দেশটাকে/ শ্যামল পরিবেশটাকে/ সবার চেয়ে প্রিয় ছিলো তাহার / টেবুল বোঝাই মুখরোচক আহার।’ কিংবা যদি বলি ‘এটুক বুঝি বাসতো ভালো আমাকে/ এমন কি মোর জামাকে/এমন কি মোর বন্ধু বান্ধব, ছাত্র ছাত্রী গোলাপের টব/ চেয়ার টেবুল র্যাকের বই।’ বোঝা যায়, দেশের প্রতি মমত্ববোধ সহজাত একটি ব্যাপার। বাবার দেশপ্রেম, এতো তাঁর স্বকীয়তা। কবিতায় বাবার অনুপস্থিতির কথা কোথাও বলা হয়নি। তবু অতীতকালীন ক্রিয়াপদের ব্যবহারে, বাবার চরিত্র রূপায়নে এক স্নিগ্ধ কারুকাজ, উপলব্ধি মিশে আছে। কবিতাটি পাঠ শেষে পরিবারের সকলের প্রতি এক গভীর টান ফুটে উঠেছে।
আসাদ চৌধুরী মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত নীতিবান কবি। ‘সত্য ফেরারী’ তাঁর সেই নীতির চেতনাকে শানিত করে রচিত একটি কবিতা। তিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, তাইতো তাঁর চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ‘সত্য’ নামের বস্তুটিকে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন নিরন্তর। তাঁর বিবেককে নাড়া দিয়েছিল ‘সত্য’ নামক বস্তুটি । ‘কোথায় পালালো সত্য?/ভেনিটি ব্যাগ বা পকেটে আঁচলে ড্রয়ারে, ব্যাংকে আয়রন সেফে সত্য নামক মহান বস্তু নেইতো/হতাশায় নেই,আশাতেও নেই, প্রেম প্রীতি ভালোবাসাতেও নেই এমনকি কালোবাজারেও নেই/কোথায় গেলেন সত্য?’ আজকালতো এই ‘সত্য’ ব্যপারটিকে আমরা নির্বাসনে দেয়ার ব্যাবস্থা করে নিয়েছি। বিষয়টি এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, সত্যকে খুঁজতে গিয়ে তিনি সমাজের প্রতিটি বস্তু কিংবা অবস্তুগত বিষয়গুলোকে নিরীক্ষা করেছেন। অন্তত সমাজে ‘সত্যকে’ টিকিয়ে রাখার বাসনা প্রবল করে তুলেছিলেন।
আসাদ চৌধুরী সম্পর্কে একটি কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, তাঁর ভেতরে দেশজতা, লোকজ দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেছেন, আফ্রিকার প্রতিবাদী রাজনীতিবিদ প্যাট্রিক লুমুম্বার উপর একটি কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর কবিখ্যাতি বেড়ে যায় এবং এর পর থেকেই তাঁর কবিতায় সমাজ এবং মানুষ বিশেষ উপকরণ হয়ে ওঠে এবং লোকসংগীতের প্রতি অনুরাগ বেড়ে যায়। তাই সচেতন একজন মানুষ হিসেবে আসাদ চৌধুরী সামাজিক বিবেককে কখনোই এড়িয়ে যাননি। তিনি খুব ইতিবাচকভাবে লোক ঐতিহ্যকে কবিতায় প্রবলভাবে তুলে ধরেছেন। প্রাচীন লোকসাহিত্য, বৈষ্ণব পদ, লালন শাহ থেকে আসাদ চৌধুরী তাঁর কবিতার উপকরণ খুঁজে পেয়েছিলেন। এসবের উল্লেখ আছে তাঁর ‘তবক দেওয়া পানের’ কাব্যগ্রন্থের ‘সন্দেহ’, ‘আয়না’, ‘ধান নিয়ে ধানাই পানাই’, ‘চোর’ কবিতাবলীতে। এসব কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার বুনন খুবই স্বভাবশোভন আর পূর্ব বাংলার লোকভাষার সংগে তিনি মিশিয়েছেন আবেগের আন্তরিক তাপ। ‘নকশী করা কেথা বানাই রঙ্গিল সুতা দিয়া/ ঘরের মানুষ বাহির হইল রুমাল উড়াল দিয়া/ বৈদেশ যার নাগর গেল চৈত বৈশাখে আইছে/ শীতল বলো ঠান্ডা বলো স্বামীর মতন নয় /বাপ বলো পুত বলো হলদীর মতোন নয় (আয়না)। কবিতাটি গ্রামীণ লোকজ উপকরণে প্রকাশিত বিরহ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। কবিতাটির ভাষায় আছে পদাবলীর সেই মেজাজ ও মনোহারীত্ব আর সেই বিপ্রলম্ভ জনিত উক্তি। ‘স্বীকারোক্তি’ কবিতায় নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বড় নগণ্য মানুষ মনে হয়েছে তাঁর। ‘চোর’ কবিতায় কবিতো রসিকতার আবরণে চোরের চারিত্রিক বর্ণনা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির শক্তি ও প্রকাশভঙ্গী এখানে তার সমকাল ছাড়িয়ে দুদিকেই প্রসারিত– অতীত থেকে তুলে এনে যেমন ভবিষ্যতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তেমনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মানবতাবোধ পদাবলী কিংবা পুঁথি সাহিত্যে কবির মতোই স্বতোৎসারিত। ‘ধান নিয়ে ধানাই পানাই’ কবিতাটি দুর্ভিক্ষের দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থ বের হওয়ার পর বইটি নিয়ে একটি পত্রিকার ‘সাহিত্য সংবাদ’ এ পুস্তক সমালোচনায় লেখা হয় “ক্ষেতের মাটি তখনো খুব নরম। কেমন যেন সোঁদা সোঁদা গন্ধ মাটিতে লেপ্টে থাকে। নাকের কাছে সে গন্ধ ভুর ভুর করে। ঘুরে ঘুরে সে গন্ধ কেবল মনটার ভিতর উথাল–পাথাল সৃষ্টি করে। হঠাৎ আসাদ চৌধুরীর কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’ হাতে পেয়ে এমনি একটি গন্ধ পেলাম। তিনি যেন মাটির কাছাকাছি ছিলেন। মাটির গন্ধ সব ছেঁচে এনে কবিতার গায়ে চড়িয়ে দিয়েছেন। সমকালীন কবিদের মধ্যে মিল থাকাটা দোষের ব্যাপার বলে গণ্য হতে পারে না। তবে আসাদের বিশিষ্টতা কোথায়? আসাদই সমকালীন কবিদের মধ্যে সবচেয়ে মাটির কাছাকাছি কবি, অথচ আধুনিকতাও তাঁর আয়ত্তের মধ্যে।”
আমরা তাই বলতে পারি, একজন বাচিক শিল্পী আসাদ চৌধুরী সময়সচেতন বৈশিষ্ট্যে উদ্ভাসিত বিবেকবান একজন সমাজ সচেতন কবি। ‘লোকজতা’ এই একটি শব্দে আসাদ চৌধুরীর কবিতাকে বেশি চিহ্নিত করা যায়। লোকজ উপাদান এবং লৌকিক শব্দের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে সমকালীন কবিদের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।