বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ নেই; এ নিয়ে আতঙ্কের মধ্যেই এবার রাজধানীবাসীর ভোগান্তিতে যোগ হয়েছে মশাবাহিত আরেক রোগ চিকুনগুনিয়া। চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ–উপসর্গ অনেকটা ডেঙ্গুর মত হওয়ায় আক্রান্ত হলেও রোগীরা বুঝতে পারছেন না। সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই। ফলে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যাও জানা যাচ্ছে না। খবর বিডিনিউজের।
তবে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক মাসে তিনশর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। আইসিডিডিআর,বি এবং আইইডিসিআরের পরীক্ষায় চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের কাছেও লক্ষণ–উপসর্গ নিয়ে অনেকে আসছেন, যাদের কেউ কেউ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে তাদের সন্দেহ। এ বছর অসময়ে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় আগামী বছর রোগটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এইডিস ইজিপ্টি এবং এইডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি টোগা ভাইরাস গোত্রের। মশাবাহিত হওয়ার কারণে একে আরবো ভাইরাসও বলে।
১৯৫২ সালে আফ্রিকায় প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ভাইরাসের হদিস মেলে। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এ রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তখন রিপোর্টিং সিস্টেম না থাকায় কত লোক আক্রান্ত হয়েছিল তার সঠিক কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সে সময় অন্তত এক লাখ মানুষের চিকুনগুনিয়া হয়েছিল।
ঢাকায় এবার রোগী কেমন : রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক কামরুন্নাহার সুলতানা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে জ্বরে আক্রান্ত হন। দুইদিন জ্বর থাকার সময় মাংসপেশিতে মৃদু ব্যথা ছিল তার। চিকুনগুনিয়া সন্দেহ করে নমুনা পরীক্ষা করালে পজিটিভ আসে।
জ্বর সেরে যাওয়ার পর আট দিন বাসায় বিশ্রাম নিয়ে কাজে যোগ দেন তিনি। এর এক সপ্তাহ পর থেকে তার শরীরের ব্যথা বাড়তে থাকে। গত কয়েকদিন ধরেই শরীরের প্রতিটি জয়েন্টে ব্যথা। কাল থেকে সেটা আরও বেড়ে গেছে। এখন আমি কার্যত ডিজঅ্যাবল। একটুও হাঁটতে পারছি না, রিকশায় উঠতে পারছি না, এমনকি স্ট্রিপ থেকে একটা ট্যাবলেট খুলে খেতে পারছি না। ২৯ অক্টোবরের থেকে পেইন কিলারের ওপরে আছি, না খেলে ব্যথায় টিকতে পারি না। কলাবাগানের বাসিন্দা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা অচিন্ত্য কুমার নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে জ্বরে আক্রান্ত হন। রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকায় চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করাতে বলেন চিকিৎসক। তাতে চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে।
অচিন্ত্য কুমারের ভাষায়, তিনি ‘শক্তসামর্থ’ মানুষ। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথায় জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। কোথাও বসলে উঠতে পারি না, বিছানা থেকে আরেকজনের হেল্প ছাড়া ওঠা যায় না। মনে হয় দুপায়ের দুটি রগে কেউ ইনজেকশন দিয়েছে, প্রতিটি জয়েন্ট, শোল্ডারের জয়েন্ট। বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় ব্যথা করে। আমি এনার্জিটিক মানুষ, একেবারে বসিয়ে দিয়েছে। ডেঙ্গু ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে চিকুনগুনিয়া নিয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। ফলে এই রোগে আক্রান্তের সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
একটি গবেষণার আওতায় আইসিডিডিআর,বি অক্টোবর মাসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ১৫১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে। যাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের সবাই ডেঙ্গুর এনএসওয়ান পরীক্ষা নেগেটিভ এসেছিল। ওই ১৫১টি নমুনার আরটিপিসিআর করে ২৭ জনের চিকুনগুনিয়া পজিটিভ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ শনাক্তের হার প্রায় ১৮ শতাংশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান–আইইডিসিআর জানিয়েছে, নভেম্বর মাসে ৪৭ জন চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত করেছে তারা।
স্কয়ার হাসপাতাল জানিয়েছে, চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়ে গত ১ নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৩১৪ জন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর হওয়ায় ৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।
স্কয়ার হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউসুফ সিদ্দিক বলেন, আমরা এবার চিকুনগুনিয়ার প্রচুর রোগী পেয়েছি। তাদের বেশিরভাগই আউটডোর সার্ভিস নিয়েছেন।
এ বছর চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহও। তার ব্যক্তিগত চেম্বারেও কিছু রোগী আসছে, যাদের লক্ষণ–উপসর্গ চিকুনগুনিয়ার মত। তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ–উপসর্গ ডেঙ্গুর মতই। তবে রোগীরা বেশি কষ্ট পায় শরীর ব্যথার কারণে। এমনিতে চিকুনগুনিয়া তেমন সিরিয়াস রোগ না। কিন্তু বাড়তি বিষয় হল প্রচণ্ড ব্যথা। এই ব্যথা আবার কারও কারও দীর্ঘ সময় থাকে, রোগীকে ভোগায়।
ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীদের একটা বড় অংশের চিকিৎসা হয় মুগদা হাসপাতালে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এস এম হাসিবুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সে কারণে তারা জানতে পারেন না রোগী চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত কিনা। আমাদের এখানে ডেঙ্গু নিয়ে অনেকে আসেন। তাদের অনেকের মধ্যেই চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ–উপসর্গ থাকে।
ব্যাপকতা বাড়ার আশঙ্কা : এ বছর চিকুনগুনিয়া পাওয়া গেছে বর্ষা মৌসুম শেষে। এ কারণে ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়া নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি বলেন, আমরা এ বছর ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়া নিয়ে বেশি চিন্তিত। এ বছর লেট সিজনে এসে চিকুনগুনিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারও চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হচ্ছে। আগামী বছর এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।