ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই অংশে দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। বছরের পর বছর ধরে দেশে পরিবহন দুর্ঘটনা যেভাবে প্রতিনিয়ত প্রাণহানির দুর্বিষহ প্রতিযোগিতায় নেমেছে; পুরো জাতি এতে চরম বিচলিত–আশঙ্কাগ্রস্ত। ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেন যেন এক অজানা মৃত্যু ভয় ছায়ার মতো মনের অগোচরে বাসা বেঁধে চলছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি–বেসরকারি সংস্থার প্রাণপণ প্রচেষ্টায়ও এর পরিত্রাণে কার্যকর কোনো সুফল দৃশ্যমান নয়। ফলশ্রুতিতে সড়ক–মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। গত ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয় ‘এক বছরে ৮৮ দুর্ঘটনা, প্রাণ গেল ৪২ জনের’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রাণের ঝুঁকি বাড়ছে। একদিকে বাড়ছে যানবাহন, অপরদিকে কোনো বহুমুখী টার্নে নেই ট্রাফিক বা গোলচত্বর। এসব স্থানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা। পুরো মহাসড়কজুড়ে বেড়েছে ঝুঁকি। মীরসরাইয়ের জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রবেশমুখে সপ্তমুখী রাস্তার মুখে মহাসড়কের সাথে নেই কোনো গোলচত্বর। আবার সেখানে যত্রতত্র পার্কিংও রয়েছে। ফলে রাস্তা পার হবার সময় দেখা যায় রাস্তার অপরদিক থেকে ছুটে আসা দ্রুতগতির গাড়ি; ঘটছে দুর্ঘটনা। গত কয়েক মাসে এ স্থানে মৃত্যুবরণ করেছে এক স্কুলশিক্ষার্থীসহ কয়েকজন। মহাসড়কের মীরসরাই অংশে এক বছরে ৮২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪২ জন, আহত হয়েছেন ১৩৪ জন। দুর্ঘটনার ঘটনায় জোরারগঞ্জ ও কুমিরা হাইওয়ে থানায় দায়ের হয়েছে ৩১টি মামলা। জোরারগঞ্জ ও কুমিরা হাইওয়ে থানা, বারইয়ারহাট ও মীরসরাই ফায়ার সার্ভিস এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে বেপরোয়া গতির বিভিন্ন যানবাহনের কারণে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট দুর্ঘটনার ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশই ঘটেছে ভারী যানবাহনের কারণে। ৮২টি দুর্ঘটনার মধ্যে ৫৪টিতে ট্রাক ও লরি জড়িত। এর মধ্যে ২৫টি ছিল ট্রাক–লরির মুখোমুখি সংঘর্ষ। এসব ঘটনায় ১৪ জন চালক ও সহকারী নিহত হন। এছাড়া ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান উল্টে যাওয়ার ২৯টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও ৩ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১টি, এতে মারা গেছেন ৭ জন। সিএনজিচালিত টেক্সির সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছেন আরও ৪ জন। যাত্রীবাহী বাসের ৪টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪ জন। এছাড়া গত এক বছরে মহাসড়ক পারাপার বা হাঁটার সময় মীরসরাই এলাকায় ১০ জন পথচারী নিহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনভিজ্ঞতা, বেপরোয়া গতি, আইন ভঙ্গের অভ্যাস ও সামনের গাড়িকে অতিক্রম করার প্রয়াস; আমাদের দেশের অধিকাংশ গাড়ি চালকের মধ্যে আছে। আর এসব কারণেই সহজে ঘটে চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনার বড় একটি কারণ হলো আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া। সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য দেশে আইন আছে ঠিকই, আইনের প্রয়োগ নেই। এর জন্য পুলিশের অনীহা বেশি দায়ী। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ব্যতীত সড়কের আইন অমান্য করার শাস্তিগুলো পুলিশ অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমেই সমাধান করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ সমস্যা না হলেও, পুলিশ হয়রানির উদ্দেশ্যে যে–কোনো একটি সমস্যা খুঁজে বের করে। যারা প্রতিনিয়ত সড়কে যানবাহন নিয়ে চলাচল করেন, তাদের কাছে বিষয়টি সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। পুলিশের ঠিক এই জায়গাটিতে স্বচ্ছতা না এলে, সড়কে আইন অমান্যের প্রবণতা কমবে না। বাংলাদেশের মতো অধিক জনবহুল দেশে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো বেশ জটিল। এতে পুলিশের লোকবল বৃদ্ধির বিষয়টিও জড়িত। তবে যেহারে আশঙ্কাজনকভাবে প্রতিদিন দেশে দুর্ঘটনা ঘটছে, তা সত্যিই উদ্বেগের কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের প্রশিক্ষণ ও পুলিশের আইন বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি–উভয়ই প্রয়োজন। সড়কের এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে, সরকারকে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে মীরসরাই অংশে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে বিহিত ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ভারী যানবাহনের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপিত করা, বিশেষত ট্রকি–লরির গতিসীমা নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বহুমুখী টার্নে দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
        







