ডেভিল হান্টের পরিবর্তে বিশেষ অভিযান : রমজানে শান্তি শৃঙ্খলায় আশীর্বাদ হোক

এম আনোয়ার হোসেন | সোমবার , ১৭ মার্চ, ২০২৫ at ৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ডেভিল ধরার জন্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি অপারেশন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সারাদেশে প্রায় দীর্ঘ একুশ দিন অপারেশন চলে। দেশের প্রায় সর্বত্র ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ভাঙচুর, খুন, ধর্ষণ, গণপিটুনি, মব জাস্টিস, সর্বশেষ ছাত্রজনতার ওপর আক্রমণসহ ইত্যাদি অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সরকার অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু করে। উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ১ মার্চ পর্যন্ত অপারেশন ডেভিল হান্ট চলে। দ্যা ডেইলি স্টারের এক ভাষ্যমতে, প্রধান উপদেষ্টা ডেভিল হান্ট নাম নিয়ে আপত্তি জানালে নামটি বাদ দেয়া হয়। কিন্তু অপারেশন আরো জোরদার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চিহ্নিত অপরাধী, সন্ত্রাসী ও মাদক চোরাকারবারীদের ধরতে বিশেষ অপারেশন চলছে। সেই সঙ্গে খানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ করে ব্যবস্থা নিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দৈনিক সমকালের এক তথ্যমতে অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১২ হাজার ৫০০ জন। তবে অভিযানের পুরো এক মাসে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামীসহ সর্বমোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৩৩ হাজার ১৪১ জন।

দেশে এর আগেও বিভিন্ন অপারেশন হয়েছিল। যেমন, বিগত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশন ক্লিন হার্ট অন্যতম। বিবিসির এক তথ্যমতে, এ অপারেশনে সেনাবাহিনী নামার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অপারেশন সম্পর্কে পুলিশকে জানানো হয়নি। ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর দিবাগত মধ্য রাত থেকে শুরু হয়ে ৯ জানুয়ারি ২০০৩ সাল পর্যন্ত অপারেশনটি চলমান ছিল। প্রথম দিনেই প্রায় ১৪০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিন মাসের এই অপারেশনে প্রায় ১১ হাজার ৬০৭ জন গ্রেপ্তার হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক বড় মাপের নেতৃবৃন্দের বাসায় তল্লাশি করা হয়েছিল। বেশির ভাগ বিএনপির নেতা কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিল।

অপারেশন ক্লিন হার্ট এর তুলনায় অপারেশন ডেভিল হান্ট কতটুকু সফল হয়েছে তা নির্ণয় করা এই মুহূর্তে কঠিন। যেহেতু অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটে। তখন সরকার এই পরিস্থিতির জন্যে তদানীন্তন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছিল। কিন্তু গ্রেপ্তার হয়েছিল বেশিরভাগ বিএনপি পন্থী লোকজন। অবশ্য অপারেশন ক্লিন হার্ট শুরুর কয়েক দিনের মাথায় তদানীন্তন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তার নেতাকর্মীদের নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন। অন্যদিকে অপারেশন ডেভিল হান্ট মাত্র ২১ দিন স্থায়ী হয়। এতে হতাহত না হলেও গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেশি।

ডেভিল হান্ট শেষ হয়েছে কিন্তু এতে ডেভিল অর্থাৎ শয়তান বা দুষ্কৃতকারীদের খুশি হবার সুযোগ নেই। যেহেতু সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা করা হয়, অপারেশন ডেভিল হান্ট নাম না থাকলেও আইন শৃঙ্খলা উন্নয়নে যৌথবাহিনীর অপারেশন আরো জোরদার করা হবে। ফলে রমজানের শুরু থেকেই যৌথবাহিনীর অপারেশন চলছে। আরেক ঘোষণায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা স্পষ্ট জানিয়েছেন, “আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া অভিযান করার কারো কোনো অধিকার নেই।” এ দিকে মানুষ অনেক জায়গায় বেপরোয়া হয়ে গেছে। তাই বিশেষ অপারেশন আরো জোরদার করা দরকার। অপারেশনকে দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক লাঠিচার্জ দৃশ্যমান করা দরকার। প্রয়োজনে অস্ত্র উদ্ধার নামে স্পেশাল ফোর্স দিয়ে আরো একটি অপারেশন সংযুক্ত করা যেতে পারে। প্রত্যেক দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে ইউনিয়ন ও থানা ভিত্তিক আইন শৃঙ্খলা কমিটি করা যেতে পারে। একইভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও শক্তিশালী করা দরকার। তাতে মানুষের জানমাল নিরাপদ হতে সহায়ক ভুমিকা রাখবে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি শূন্যতা দেশে অপরাধ বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ। যেহেতু ইউপিতে চেয়ারম্যান নেই, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে মেয়রকাউন্সিলর নেই। দেশে একমাত্র চসিক মেয়র ছাড়া অন্য কোনো মেয়র নেই। নাগরিকের জন্যে বিকল্প সেবার ব্যবস্থা করা হলেও স্থানীয় শালিসবিচার এবং অপরাধ রোধে এই শূন্যতা অপূরণীয় থেকে যায়। ফলে সারা দেশে অনেকটা মব জাস্টিস শুরু হয়েছে। তাই এ শূন্যতা পুরণে কার্যকর ভুমিকা প্রয়োজন। প্রয়োজন নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। এ সব জায়গায় নিযুক্ত প্রশাসকগণ নিজের কাজের বাইরে সময় দিতে গিয়ে তাদের মূল কাজে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

আজকাল মানুষের মন মেজাজ কেন জানি এক রোখা হয়ে গেছে। যেন দীর্ঘ খরার পর নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। যারা বিগত সরকারের আমলে বিড়ালের মত ছিল, এখন তারাই বাঘসিংহে রুপান্তর হয়ে গেছে। যত্রতত্র গায়ের জোর প্রদর্শন করছে। আশ্চর্য! আবার কোথাও ৮ বছরের শিশু সন্তান পর্যন্ত ধর্ষণের হাত থেকে রেহায় পাচ্ছে না। এ সবের মাঝেও সরকারের সফলতা কম নয়। বিধবস্ত শাসন ব্যবস্থা সচল করা, সম্পুর্ণ ভেঙে পড়া পুলিশ বিভাগের পুনরুদ্ধার, ঢাকা ও চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুত গতিতে চলমান কাজ, ভেঙে পড়া আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিকীকরণের অগ্রগতি, নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি, আইন শৃঙ্খলার প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী ছাত্রদের লিডারশিপের আওতায় নিয়ে আসা, ভেঙে পরা রাষ্ট্রকাঠামোর উত্তরণসহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার সফলতা অর্জন করেছে বলা যায়। আসুন, অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচার থেকে দূরে থাকি। অন্যকে নিরুৎসাহিত করি। মনে রাখা দরকার, এ সব সঠিকভাবে পালনে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি শৃঙ্খলা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগন্ধরাজে সুখ
পরবর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান ও আবদুল্লাহ আল নোমান