সংবাদমাধ্যম ইকোনমিস্ট বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে বাড়ছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন অন্তত ১০ কোটি মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এরইমধ্যে তা বুঝতে শুরু করেছে বিশ্ব। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়তে থাকা গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে জনপদ। তীব্র গরমে যেখানে বাইরে বের হওয়াই দায়, সেই মুহূর্তে সামনে এলো আরেক আতঙ্কের খবর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যানুয়ায়ী, ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আর চলতি বছর বিশ্বে ৪০ হাজার মানুষ মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত অঞ্চল লাতিন আমেরিকা। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালে সেখানে বছরে গড়ে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। কিন্তু ২০২৩ সালে অঞ্চলটিতে ৪৬ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর চলতি বছর এরই মধ্যে ওই অঞ্চলে প্রায় ৬০ লাখ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ব্রাজিলে।
ইকোনমিস্ট বলছে, শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। বিশ্ব যত উষ্ণ হয়ে উঠছে, তার সঙ্গে বাড়ছে এডিস মশার উৎপাত। অ্যানেফিলিস মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায়, যা এখন সারা বিশ্বেই পাওয়া যায়। কিন্তু এডিস এখনো সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু জলবায়ুর বর্তমান প্রবণতা অনুযায়ী, এডিস মশা দক্ষিণ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে আরো ২০০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
মশার বংশবিস্তারে সাহায্য করছে নগরায়নও। কিছু স্থানে এই রোগ আগে ছিলো না কিন্তু এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রবণতা এখন বাংলাদেশ ও ভারতে দেখা যাচ্ছে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ, আফ্রিকায় ডেঙ্গু আক্রান্তে সংখ্যা বেড়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কিন্তু জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। কীটতত্ত্ববিদরা মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। এজন্য প্রথমত, চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশা বেশি জন্মায়। দ্বিতীয়ত, জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় মশা বেশি, কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে, তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যেন এসব জায়গায় নতুন করে মশা জন্মাতে না পারে। এছাড়া মশার অতিরিক্ত প্রজনন বন্ধের জন্য জলাশয়ে মাছ, হাঁস ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবশেষ সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ চারটিকে একত্রে কীটতত্ত্ববিদদের মতে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ বলা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকা শহরে বসবাসরতদের ঝুঁকি বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুতে রাজধানীর সব বাসিন্দা আক্রান্ত হতে পারেন। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে নাগরিকদের সচেতনতাও প্রত্যাশা করেন তাঁরা। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে চলবে না, কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
মনে রাখতে হবে পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন ডেঙ্গু থাকবে। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। গবেষণা ও পর্যালোচনা করে স্থায়ীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নইলে দিনদিন সমস্যা বাড়তেই থাকবে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ থেকে আরও ভয়াবহ হবে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতির এতই অবনতি হবে যে, আগামীতে তা সামাল দেওয়া যাবে না।