এডিস মশাবাহিত মরণঘাতী ডেঙ্গু জ্বরে রক্ত জোগাড়ের ভোগান্তির হয়তো অবসান হবে এবার। প্ল্যাটিলেট (রক্তের অণুচক্রিকা) বাড়াতে ও রক্তক্ষরণ বন্ধে কার্যকর ওষুধ পাওয়ার দাবি করেছেন বাংলাদেশি একদল গবেষক। ‘এলট্রম্বোপ্যাগ’ নামের একটি জেনেরিক ওষুধের (ট্যাবলেট) স্বল্পমাত্রার সংক্ষিপ্ত ডোজ ডেঙ্গু রোগীদের প্রয়োগ করে তারা কার্যকারিতা পেয়েছেন বলে চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী দ্যা ল্যানসেটে তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মৌসুমী সান্যাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এএইচএম নুরুন নবীসহ ১২ জনের দলটি যৌথভাবে এই পরীক্ষা চালান। ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল হয়ে পড়লে, লিভারের মারাত্মক জটিলতার কারণে অথবা লিউকোমিয়া (রক্তের ক্যান্সার) রোগীদের ক্যামোথেরাপি দেওয়ার কারণে প্ল্যাটিলেট কমে যায়, যে পরিস্থিতিকে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বা থ্রম্বোসাইটিস বলা হয়। এসব পরিস্থিতিতে এলট্রম্বোপ্যাগের কার্যকারিতা প্রমাণিত। উপসর্গজনিত মিল থাকার কারণে ডেঙ্গুজনিত প্লাটিল্যাট স্বল্পতায়ও এই ওষুধের কার্যকর হবে ধরে নিয়ে গবেষণার পরিকল্পনা করা হয়। খবর বিডিনিউজের।
অধ্যাপক নুরুন নবী বলেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর আক্রমণে ঢাকাবাসী জর্জরিত। ডেঙ্গুতেও যেহেতু প্ল্যাটিলেট সংখ্যা কমে যায়, তাই ডেঙ্গু হলেই রক্ত জোগাড়ে মানুষ অস্থির পড়ে। এমনি এক মুহূর্তে এক অসহায় রোগী ব্লাড ম্যানেজ করতে না পারলে তাকে বাঁচাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. মৌসুমী ‘এলট্রম্বোপ্যাগ’ ওষুধটি ব্যবহার করেন। এতে পরের দিনই ওই রোগী ভালো হয়ে যান। এই সুফলের ফলে তিনি আরও চারজন অসহায় রোগীর চিকিৎসা করেন। কিন্তু মোট পাঁচ জনের মধ্যে দুইজন ভাল ফল পান, দুইজন মোটামুটি আর একজনের ফলাফল আশানুরূপ পাওয়া যায়নি। পরে ডা. মৌসুমীর সঙ্গে মিলে তারা যৌথ উদ্যোগে ১০১ জন ডেঙ্গু রোগীর ওপর এলট্রম্বোপ্যাগ প্রয়োগ করে ওষুধটির ‘কার্যকরিতার প্রমাণ’ পেয়েছেন বলে তিনি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ওষুধটির কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কিনা, সেটাও আমরা দেখেছি। কারণ অনেকের প্লাটিলেট বেড়ে গেলে সেটা ক্ষতির কারণও হতে পারে। কিন্তু আমরা এরকম কিছু পাইনি। শুধু তিন শতাংশের ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার মতো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পেয়েছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেটার লাইফ হাসপাতাল ও এ এম জেড হাসপাতাল থেকে পরিকল্পনামাফিক ডেঙ্গু রোগীদেরকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে সাধারণ ডেঙ্গু রোগী ৭৭ জন ও রক্তক্ষরণসহ ডেঙ্গু রোগী ছিলেন ২৪ জন। ওষুধটির ক্লিনিক্ল্যাল প্রয়োগের বর্ণনা দিয়ে নুরুন নবী বলেন, এর রোগীরকে তিনটি দলে বিভক্ত করে দুটি দলের একটিকে প্রতিদিন একটি করে ৫০ মিলিগ্রামের ও আরেকটিকে ২৫ মিলিগ্রামের এলট্রম্বোপ্যাগ ট্যাবলেট সেবন করানো হয় এবং অপর দলকে মানসম্পন্ন প্রচলিত চিকিৎসা দেওয়া হয়। সব রোগীকেই সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। যাদেরকে ২৫ মিলিগ্রাম দেওয়া হয়, তাদের ৯১ শতাংশ রোগীর এবং যারা ৫০ মিলিগ্রাম পেয়েছিল, তাদের ৯৭ শতাংশ রোগীর প্ল্যাটিলেট সাড়ে তিন লাখের উপরে উঠে যায়। আর অপর দলটির ৫৫ শতাংশ রোগী ওই সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক মাত্রা অর্জন করেন।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই পরীক্ষামূলক প্রয়োগে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট বৃদ্ধি ও রক্তক্ষরণ বন্ধে ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের চিকিৎসায় এলট্রম্বোপ্যাগের উচ্চতর ডোজ (৫০মিগ্রা/প্রতিদিন) চেয়ে নিম্নতর ডোজ (২৫মিগ্রা/প্রতিদিন) প্রয়োগ বেশি নিরাপদ ও সমানভাবে কার্যকর হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। অধ্যাপক নুরুন নবী বলেন, এই ওষুধ ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে আসেনি। আরও বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা করে সফলতা পাওয়া গেলে তখন নিশ্চয়ই এটা ডেঙ্গুর চিকিৎসার গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত হবে। আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য হলো, সবাইকে যাতে রক্তের জন্য দৌড়াতে না হয়। এই ওষুধের মাধ্যমে যাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা সুফল পান। বাংলাদেশের একটি ওষুধ কোম্পানির অর্থায়নে এই গবেষণা দলে আরও ছিলেন- ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. আহমেদুল কবির, ডা. রোবেদ আমিন, ডা. চৌধুরী তামান্না তাবাস্সুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সজীব চক্রবর্তী, স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সারওয়ার আলম, মোহাম্মদ সায়েম, তন্ময় দাশ ও পিয়াল সাহা, স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক বার্থোলোমিয়া কেয়া বেপারী, আইচি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ সায়েম।