ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন জাতীয় পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল প্রণয়ন

| শনিবার , ২৪ জুন, ২০২৩ at ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

দেশজুড়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে তার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উদ্বেগ বাড়ছে জনসাধারণের মাঝে। গত ২০ জুন দৈনিক আজাদীতে ‘উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ডেঙ্গু, দেরিতে হাসপাতালে আসাই মৃত্যুর অন্যতম কারণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় মধ্য আগস্টের পর। তবে এবার জুনের আগেই এর প্রকোপ শুরু হয়েছে। দিন দিন এ প্রকোপ বেড়েই চলেছে। প্রকোপ শুরু হতেই ডেঙ্গুতে পরপর মৃত্যুর ঘটনা এবার উদ্বেগও বাড়াচ্ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ৭ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে তিন জনের মৃত্যু হয় জানুয়ারিতে। আর চারজনেরই মৃত্যু হয়েছে ৫ দিনের ব্যবধানে, গত ১৪ জুন থেকে ১৮ জুনের মধ্যে। মৃতের তালিকায় শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, তরুণ, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। টানা কয়েকদিন ধরে পরপর মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য বিভাগকে। ডেঙ্গুতে পরপর এই মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। এভাবে নিয়মিত মৃত্যুর ঘটনা ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আভাস দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এজন্য সকলকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন সিভিল সার্জন। জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গু শনাক্তে দেরি এবং রোগীকে হাসপাতালে আনতে বিলম্বের কারণেই আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাকিল ওয়ায়েজ বলছেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা যেটি দেখছি, বেশ কিছুদিন জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গুসহ কোন টেস্ট না করে রোগীকে বাসায় রাখা হচ্ছে। এরপর অবস্থা খুব খারাপ হলে তখন রোগীকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে আমরা এ রকম তথ্য পাচ্ছি। শুধু দেরি করার কারণেই এবং শুরু থেকে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

কীটতত্ত্ববিদদের মতে, নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় মশা উৎপাদন ক্ষেত্র বিনাশ করা সম্ভব হলে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। তাঁরা বলেন, সাধারণত মশক নিধন কার্যক্রমের স্থবিরতা, গাইডলাইনের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতাই ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য দায়ী। হঠাৎ থেমে থেমে স্বল্পমেয়াদি বৃষ্টিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা খুব বেশি মাত্রায় প্রজনন সক্ষমতা পায়। ফলে এডিস মশার বিস্তারও ঘটে বেশি। উৎস বন্ধ না করতে পারলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। সরকার এবং জনগণের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এ মহামারি থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে। পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা, মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, মশক নিধন কীটনাশক প্রয়োগ এবং গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের পাশাপাশি কমিউনিটিভিত্তিক সচেতনতা কার্যক্রম জরুরি বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ডেঙ্গু সারা বছরই ছিল। গত বছর বর্ষাকালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল। বর্তমানে বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। যেহেতু বাংলাদেশে নগরায়ণ এখন উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত, কোনো কোনো ইউনিয়নেও পাকা রাস্তাঘাট ও বিল্ডিং রয়েছে। আমরা ভৌগোলিকভাবেও অত্যন্ত ছোট দেশ। ফলে ডেঙ্গু মশা ও রোগী সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে এডিস মশা আছে কিন্তু রোগী নেই সেখানে ডেঙ্গু ছড়াবে না, আবার যেখানে রোগী আছে এডিস মশা নেই সেখানেও ডেঙ্গু ছড়াবে না। কিন্তু এখন দুটোই ছড়াচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বৃষ্টি হওয়ার পর যেসব স্থানে পানি জমে যেমন বাড়ির ছাদ, সরকারি বিভিন্ন অফিস আদালতের ছাদ, বিভিন্ন থানায় জব্দ করা গাড়িতেও পানি জমে থাকে, কিন্তু সেগুলো কেউ পরিষ্কার করে না, ডাবের খোসা, বিভিন্ন খাবারের টিনের এবং প্লাস্টিকের কৌটাপ্যাকেট সেগুলোতেও বৃষ্টির পানি জমে, সেগুলো বন্ধ করতে হলে একদিকে যেমন কর্তৃপক্ষ এবং আরেক দিকে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্থানীয়ভাবে ছাত্র ও যুবকদের যে বিভিন্ন ক্লাব রয়েছে, তারা প্রতিটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোথায় পানি জমে সেগুলো বিষয় খুঁজে বের করবে এবং সেই পানি জমার স্থানগুলোতে পানি যেন না জমে, সেই ব্যবস্থা করবে এবং ভবিষ্যতে যেন এসব স্থানে পানি না জমে সেই বিষয়ে প্রতিটা পরিবারকে সচেতন করবে। স্থানীয় কমিউনিটির এসব ভলান্টিয়ারদের ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অন্যদিকে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ জাতীয় পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল প্রণয়ন এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে যুক্ত করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে