ডেঙ্গুর জীবাণুবাণী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে সামনের বছরগুলোতে রোগটি আরও ব্যাপক আকারে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল শনিবার ঢাকার নিপসম মিলনায়তনে এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ পেয়েছে। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা ঢাকার বাইরে পাওয়া যাচ্ছে। এতে সামনে এই রোগটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার চেয়ে বাইরের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা কয়েক গুণ। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে; যা ঢাকা নগরীতে ভর্তি রোগীর প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া ঢাকা নগরীর বাইরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এ সংখ্যা ৪২ হাজার ৪৪০ জন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১১৬ জনের। খবর বিডিনিউজের।
বৈঠকে এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা। শহরে ডেঙ্গু ছড়ানো এডিস ইজিপ্টি মশা নিয়ে আলোচনা হয়। তবে অ্যালবোপিকটাস নিয়ে কেউ ভাবছে না। অথচ ধানগাছ, কলাগাছের পাতা, গাছের কোটর, এমনকি কচুগাছের পাতায়ও এডিস অ্যালবোপিকটাসের লার্ভা হয়। বাংলাদেশে এখন সারা বছর দেশজুড়ে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুতেও রেকর্ড হয়েছে। পাশাপাশি শুক্রবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ লাখ ৬ হাজার ৪৩৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ৬ হাজার ৬৭৮ জন এবং ঢাকার বাইরের প্রায় দ্বিগুণ ১ লাখ ৯৯ হাজার ৭৫৯ রোগী ভর্তি হয়েছে। আর এ বছর মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৮৩। এর আগে কখনই এত রোগী বা মৃত্যু কোনোটাই দেখেনি বাংলাদেশ। রোগতত্ত্ববিদ সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, সংখ্যা (আক্রান্ত ও মৃত্যু) কিন্তু অনেক কিছু বলে না। আগে মশা এবং আক্রান্ত রোগী শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সন্দেহজনক রোগীর সংখ্যাও কম ছিল। এখন সারা বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষই সন্দেহজনক। সুতরাং যদি তখন ১ শতাংশ হয়ে থাকে, আর এখন যদি ১ শতাংশ হয়, সেটার ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, সেটা আমরা কল্পনা করতে পারি?
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক এ পরিচালক বলেন, বেইজলাইনে যে সংখ্যাটা আসবে, সেটাও কিন্তু অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমি কথাটা আবার জোর দিয়ে বলতে চাই, আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং সতর্কবাণী হিসেবে রোগতত্ত্বের মানুষ হিসেবে এই ফোরাম বলতে চাই, এটা বড় আকারে আসার আশঙ্কা রয়েছে, যদি না আমরা এখনই শক্তিশালী, সমন্বিত পদক্ষেপ নিই।
সারা বছরে ডেঙ্গুতে পাঁচশ রোগী হতো না। এখন সেখানে প্রতিদিনই পাঁচশর বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে। অথচ ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কোনো পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়নি।
সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, মহামারীবিদদের সংগঠন সরকারকে যেকোনো প্রয়োজনে সহায়তা করতে তৈরি। ডেঙ্গুর জন্য আমরা একটা পরামর্শক কমিটি দেখি নাই। আমি জানি না সেইখানে আমরা অবদান রাখতে পারতাম কিনা। আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আহ্বান জানাচ্ছি, এপিওডেমিলজি অ্যাসোসিয়েশন তৈরি, জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক তথ্য, তত্ত্ব, বিশ্লেষণ; যেকোনো ধরনের তথ্য দিতে আমরা তৈরি আছি।
আইসিডিডিআরবির গবেষক ডা. শফিউল আলম বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে হলে এই রোগের জীবানুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। মশা নিধনে লার্ভিসাইডিং ভালো কাজে আসবে। তবে দীর্ঘদিন একই কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মশা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করে ফেলে। ফলে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিটিআই ভালো সমাধান।
একদিনে ১২ মৃত্যু : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৭৫৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৯৬ জন। এতে এ বছর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৩৪ জনে। ঢাকায় এ সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার ৮৬২ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ১২ জনের, যা নিয়ে মোট প্রাণহানি হয়েছে ১৫৯৫ জনের। এদের মধ্যে ৯২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়। বাকি ৬৭০ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন।