বর্ষা শুরুর পর থেকে এ বছর ঢাকায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা বেড়েই চলছে। হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এবারও ডেঙ্গু ভোগাবে মানুষকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সোমবার পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৪৪২ জন। বছরের প্রথম ছয় মাসে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে বছরের প্রথম ছয় মাসে এর চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি এবং মৃত্যু হয়েছিল ২০২৩ সালে। সে বছর জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। তার আগে বছরের এই সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়নি। খবর বিডিনিউজের।
ঢাকায় প্রস্তুতি কেমন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় গত ১৭ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় মশার ঘনত্ব মাপতে জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৯টি ওয়ার্ডের ৩১৫২টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। ২৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরিদর্শন করা বাড়ির মধ্যে ৪৬৩টিতে এডিস মশার লার্ভা এবং পিউপা পাওয়া গেছে; যা পরিদর্শন করা মোট বাড়ির ১৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। লার্ভা পাওয়ার শতকরা হার বা হাউস ইনডেক্স ১০–এর বেশি হলে মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বিবেচনা করা হয়। সেদিন মশার এই উপস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা আশঙ্কা করেছিলেন, বর্ষায় এডিস মশার ঘনত্ব আরও বাড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এম এম আক্তারুজ্জামান মঙ্গলবার বলেন, বর্ষা পূর্ববর্তী জরিপে মশার যে উপস্থিতি পাওয়া গেছে, সেটি ছিল উদ্বেগজনক। বর্ষায় বৃষ্টিপাতে মশা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, হচ্ছে। একটা ভারী বৃষ্টি হলেই বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে যাবে, মশার ব্রিডিং সোর্স বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরিপ করে মশক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে একটা ইনডিকেশন দেয় কোন কোন এলাকায় মশার বিস্তার বেশি।
ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, স্থানীয় সরকারের ডেঙ্গু কন্ট্রোল ইউনিট, সিটি করপোরেশন ওইভাবে ভাগ ভাগ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়। কাজেই মশক নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে যেন পানি জমতে না পারে, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ ও এডিস মশার প্রজননস্থল নিধনে গত রোববার থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। অভিযানে বিভিন্ন বাসাবাড়ি, স্থাপনায় এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরের প্রথম থেকেই কাজ শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সব হাসপাতাল এবং থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছেন তারা। ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করছি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য। অভিযানে কিছু কিছু জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, তবে সেটা খুব বেশি নয়।
ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, গত বছর জুন পর্যন্ত ১৭১৩ জন রোগী পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়, চলতি জুন পর্যন্ত ৬২ জন। আমরা বলব গত বছরের চেয়ে আমরা ভালো অবস্থায় আছি। তারপরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক।
মশার ঘনত্ব নির্ণয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ। এতে ঢাকার উত্তরা, মিরপুর–১, মিরপুর–২, গুলশান ও মোহাম্মদপুর এলাকায় চারটি প্রক্রিয়ায় মশার উপস্থিতি দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে চার ধরনের ফাঁদ পেতে পূর্ণ বয়স্ক, গর্ভবতী মশা ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে মশার লার্ভার উপস্থিতি দেখা হয়। মশা নিয়ে এই সার্ভিলেন্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু মশা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কমেছে অন্য মশা। গত সপ্তাহের চেয়ে এই সপ্তাহে কম পেয়েছি। আমরা যে জায়গাগুলোয় কাজ করি, একই জায়গায় সিটি করপোরেশন হয়তো খুব অ্যাকটিভলি কাজ করছে। এ কারণে মশা কমেছে। তবে ডেঙ্গু আগের চেয়ে বেশ বেড়েছে।
বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা করছেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। সোমবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবার বর্ষা শুরুর আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রচারণা চালানো হচ্ছে, ডিএসসিসির কর্মীরা নিয়মিত ওষুধ দিচ্ছে। আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের বাসা–বাড়িসহ আঙিনার কোথাও পানি জমে থাকছে কিনা। যদি পানি জমে থাকে, পাত্রটি উল্টে দিন। পরিত্যক্ত পাত্র কাজে না লাগলে ধ্বংস করে ফেলুন। কারণ এসব পাত্রেই এডিস মশা বংশ বিস্তার করে।
রোগীও বেশি : এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৩৪৯৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জুনের প্রথম ২৬ দিনে হাসপাতালে এসেছেন ৬৪৩ জন রোগী। দেখা গেছে, ১ থেকে ৭ জুন পর্যন্ত মাসের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালে এসেছেন ১৬৬ জন, দ্বিতীয় সপ্তাহে ১৭৪ জন, তৃতীয় সপ্তাহে ১২২ জন এবং ২২ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত হাসপাতালে এসেছেন ১৮১ জন রোগী। ১৭ জুন কোরবানির ঈদের আগে–পরে দীর্ঘ ছুটি থাকায় হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছে কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩ সাল ছাড়া বাংলাদেশে বছরের প্রথম ছয় মাসে এত রোগী ভর্তি হয়নি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত মৃত্যুও ছিল না। চলতি বছর ২৬ জুন পর্যন্ত ৪৩ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৮ জন মারা যায়। ২০২০ সালের পুরো বছরে মৃত্যু হয়েছিল ৭ জনের। ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১২ জন, ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১ জন এবং ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৪৩ জন মারা গিয়েছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, আবহাওয়ার যে পরিস্থিতি তাতে এ বছর মশার উৎপাত গত বছরের চেয়ে বেশি হবে। মশা বাড়লে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগীর অনুপাতে মৃত্যু বেশি। মৃত্যু কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে সময় লাগবে, কিন্তু মৃত্যু কমানোর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সরকারি রেটে ডেঙ্গু পরীক্ষা সহজ করতে হবে। আক্রান্ত রোগীদের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যা কমে আসবে।