দৈনিক আজাদীতে ১৭ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি করায় নগরের সাত ডিম ব্যবসায়ীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাসরিন আকতারের নেতৃত্বে গত বুধবার আগ্রাবাদ চৌমুহনী বাজারে পরিচালিত অভিযানে এ জরিমানা করা হয়। নাসরিন আকতার সাংবাদিকদের জানান, পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে মূল্য তালিকা যথাযথ সংরক্ষণ না করা, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডিম বিক্রির কারণে জরিমানা করা হয়েছে।
ডিমের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিকে সাধারণ মানুষ অস্বাভাবিক ভাবছেন। কেননা, এতো দাম তা কল্পনারও বাইরে। ডিমের দাম বাড়বে না, এমন দাবি কিন্তু কেউ করে না। অন্যান্য জিনিসের মতো ডিমের দামও বাড়বে। অর্থনীতিবিদরা বরং বলবেন, ডিমের উৎপাদক আর বিক্রেতাদের তো এটা বেচে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হয়। সে সবের দাম যেহেতু বেড়েছে, তাই ডিমের দাম না বাড়লে তারা মারা পড়বে। তাছাড়া ডিমের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে তাদের পণ্যের দামও বাড়বে। মুরগির বাচ্চা, তার খাবার, ওষুধ, বিদ্যুৎ বিল, মজুরি ইত্যাদি বাড়লে ডিম স্বভাবতই তাদের বেচতে হবে বেশি দামে। একাধিক ক্রেতা অভিযোগ করেছেন, ডিমের বাজারে অস্থিরতার জন্য সিন্ডিকেটই দায়ী। তাঁরা বলেন, সিন্ডিকেটের হোতা কয়েকটি কর্পোরেট কোম্পানির সঙ্গে খামারিরা মিলে যোগসাজশ করেই উৎপাদক পর্যায়ে ডিমের দাম বাড়িয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে খুচরো আর পাইকারি বাজারেও।
বলা বাহুল্য, রেয়াতসহ নানা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিচ্ছেন পোলট্রিশিল্প মালিকরা। কিন্তু এসব সুবিধার প্রতিফলন নেই বাজারে। ডিমের বাজারে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে পোলট্রি, ডেইরি ও ফিশ ফিডের উৎপাদনমূল্য পর্যালোচনার জন্য তাগিদ দিয়েছেন অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজার পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, ডিমের চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে ঘাটতি না থাকলেও অদৃশ্য কারণে বাজারে অস্বাভাবিকভাবে এর দাম বেড়েছে। বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, সরকারের বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, দেশের পোলট্রি ফার্মগুলোকে গত ২০২১–২২ অর্থবছরে ৭৭০ কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠক সূত্র জানায়, বর্ষার জন্য পেঁয়াজের বাজারে দাম কিছুটা বেড়েছে। এ জন্য আগামী অক্টোবর পর্যন্ত আমদানির মাধ্যমে পেঁয়াজের মজুদ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সমন্বিত নীতিমালা, পণ্যের চাহিদা–মজুদ সরবরাহ লাইনের প্রকৃত তথ্যের ঘাটতির ফলে ডিম, তেল, চিনি, লবণ, আটা, পেঁয়াজসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহে নজরদারি বাড়ালে বাজারে যৌক্তিক দামে এসব পণ্য পাবে ভোক্তারা। ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তবে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দিয়ে শুধু নজরদারি করলেই হবে না, নীতি সহায়তাও দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিতে হবে। সরকারের ভুলনীতির কারণে যেন শিল্পের সংকট না হয় সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
বিশ্লেষক হাসান মামুন লিখেছেন, বাজারে অব্যবস্থাপনা যে রয়েছে, তাতে কারও সন্দেহ নেই। ডিম উৎপাদকদের মধ্যে ছোটরা বড়দের অভিযুক্ত করছে, এমন পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে বারবার। যারা কম উৎপাদন করে, ‘মার্কেট শেয়ার’ বড়জোর ২০ শতাংশ–তারা কীভাবে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করে ফায়দা লুটছে, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা অবশ্য নেই। এ খাতের করপোরেট হাউজগুলোও বলে যে, তাদের মুনাফা হচ্ছে না। দাম লাফিয়ে বাড়লে ‘অতীতের লোকসান’ কিছুটা পোষানো যায় বলেও তারা বক্তব্য দিয়ে থাকে। কথাটা কতখানি সত্য, সে প্রশ্নও আছে। তবে তাদের হিসাব আলাদা। তারা হয়তো একই সঙ্গে করছে ফিড ও মুরগির বাচ্চা সরবরাহের ব্যবসা। এতে করে হয়তো ভালোই পুষিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডিম বাজারজাতকরণে অতিমুনাফা ও ত্রুটিপূর্ণ মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির ফলে ডিমের বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতে ডিমের মূল্য প্রতি ডজনে বাংলাদেশি টাকায় ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, যা বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেক। দেশে ডেইরি ও পোলট্রি ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হলে বাজারে এর সুফল মিলছে না। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিমের বাজার অস্থিরতার জন্য দায়ী সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করতে হবে।