প্রাক্কথন
‘আফ্রিকা’ নামটি শুনলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কালো মানুষের দেশ। জঙ্গলময় চারিদিক। আদিবাসী। আদিম সংস্কৃতি। যারা কিনা প্রকৃতি পূজারী। এ–এক রহস্যময় জগৎ। বাস্তবতা তা নয়। জীব বৈচিত্র্য, খনিজ সম্পদ ও বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই আফ্রিকা।
সভ্যতার ক্রমবিকাশে আফ্রিকাও আলোকিত হতে থাকে। রহস্যময় জগৎ উন্মোচিত হয়েছে। বিশ্ব বরেণ্য ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রুশ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষে আফ্রিকার উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে জাঁ রুশের হাত ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এলেন নাইজারের চলচ্চিত্রকার ওমরু গানডা। পরবর্তী সময়ে সেনেগালের ওসমান সেমবেনে–ই হলেন আফ্রিকান চলচ্চিত্রের প্রকৃত জনক। ১৯৬৮ সালে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মানি অর্ডার’ বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে আফ্রিকান চলচ্চিত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে। সেই থেকে আফ্রিকান চলচ্চিত্রের নতুন ধারা শুরু হয়। পরবর্তীতে ওসমান সেমবেনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে পরিচিতি পেয়েছেন পলিন ভিয়েরা, সুলেইমান সিসে, মেড হণ্ডো, বেন বারকা, ইউসুফ শাহীন, হেইলে গ্যারিমার, জিব্রিল দিয়োপ মেমবেতি, খালেদ ইউসুফ, নাদের জালাল প্রমুখ। তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্র বিশ্ব জুড়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।
চট্টগ্রামে আফ্রিকান চলচ্চিত্র উৎসব
সাধারণত আমরা হলিউড, ইউরোপ ও ভারতের চলচ্চিত্র উপভোগ করে থাকি। এর বাইরে এদেশে অন্তত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নেই, যদি না কোনো চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এমনই এক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এবং চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট। এই দুই সংগঠনের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো গত ১০–১১ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে আফ্রিকান চলচ্চিত্র উৎসব। নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য এই আয়োজন বিশাল পাওয়া। এই দুইদিনে মোট চারটি আফ্রিকান চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এগুলো হচ্ছে :
এক. The Money Order
দুই. Yeelen
তিন. Maki’la
চার. A Screaming Man
‘আমরা সচরাচর হলিউড, ইউরোপ ও ভারতের চলচ্চিত্র উপভোগ করার সুযোগ পাই। আফ্রিকা মহাদেশের চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠে না। এই উৎসব আমাদের সে–সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে। ‘আফ্রিকান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দ তাঁদের বক্তব্যে এ–কথা বলেন।
১০ নভেম্বর বিকেল চারটায় উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ও শিশু সংগঠক, চট্টগ্রাম ফিল্ম ইন্সটিটিউটের উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গবেষক–লেখক–চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণ যোগাযোগ বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সহিদ উল্যাহ। তিনি আফ্রিকার চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চট্টগ্রামের পরচসলক ব্রুনো ল্যাকরাম্পে ও উপ পরিচালক ড.গুরুপদ চক্রবর্তী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি শৈবাল চৌধূরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মুখপত্র ডিপ ফোকাসের আফ্রিকান চলচ্চিত্র সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
ডিপ ফোকাস : আফ্রিকান চলচ্চিত্র উৎসব সংখ্যা
আফ্রিকান চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের জানার কৌতূহল যেমন আছে, তেমনি পড়ার অদম্য বাসনাও আছে। কারণ, এক মলাটে আফ্রিকান চলচ্চিত্র নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ এর আগে হয়েছে কিনা মনে পড়ে না। চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট এই উপলক্ষে তাদের মুখপত্র ‘ডিপ ফোকাস’ শুধু আফ্রিকান চলচ্চিত্র নিয়ে প্রকাশ করায় চলচ্চিত্রানুরাগীদের কৌতূহল মেটাতে সক্ষম হয়েছে বলা যায়।
এবারের ‘ডিপ ফোকাস’–এ আফ্রিকান চলচ্চিত্র নিয়ে লিখেছেন : পল্লল ভট্টাচার্য ( মুক্তি সমাসন্ন : ‘ছায়াবৃত আফ্রিকা ’, কমলেশ দাশগুপ্ত ( ওমর শরীফ : বিশ্ব চলচ্চিত্রের স্মরণীয় অধ্যায়) আলম খোরশেদ ( ওসমান সেমবেনে : দেখা ও শোনা), ড. মোহাম্মদ সহিদ উল্যাহ ( আফ্রিকান চলচ্চিত্র ভাবনার পাঠ) বিধান রিবেরু ( টুকিবুকির পঞ্চাশ পূর্তি : আফ্রিকার গদার শুনিয়েছিলেন হায়েনার গল্প), ড. মো. মোরশেদুল আলম ( ব্যাটল অব আলজিয়ারস : চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন), আরাফাতুল আলম ( সোলেইমান সিসে : আফ্রিকার চলচ্চিত্রের একজন অগ্রদূত), নাজমুল আলম ইমন ( A Glimpse into the History of African Cinema), সঞ্জয় বিশ্বাস (লে স্পেক্টার ডি বোকো হারাম : যুদ্ধের পটভূমিতে বহমান জীবনের আখ্যান), শহীদুল ইসলাম রিয়াদ ( একটি দেশ, একটি যুদ্ধ এবং কিছু সিনেমা), মনিরুল মনির ( ওসমান সেমবেনে ও আফ্রিকা : বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়), শৈবাল চৌধূরী (কালো আফ্রিকার আলোর ছবি), শাহীন মাহমুদ ( আফ্রিকান চোখ)।
শৈবাল চৌধূরী সম্পাদিত ‘ডিপ ফোকাস’ আফ্রিকান চলচ্চিত্র সংখ্যাটি নানাদিক থেকে গুরুত্ব বহন করছে। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত চলচ্চিত্রপ্রেমী ও বোদ্ধা মহলে আফ্রিকান চলচ্চিত্র নিয়ে যে কৌতূহল, জানার আগ্রহ, তা ‘ডিপ ফোকাস’ অনেকটাই মেটাতে সক্ষম।
ড. মোহাম্মদ সহিদ উল্যাহ তাঁর প্রবন্ধে (আফ্রিকান চলচ্চিত্র ভাবনার পাঠ) লিখেছেন: ‘আফ্রিকান চলচ্চিত্র সমসাময়িক ইউরোপিয়ান আর্ট ফিল্ম সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে– যা হলিউড, মিশর কিংবা ভারতের বোম্বে মার্কা অতিবাণিজ্যমুখী সিনেমার মতো নয়।’ আসলেই তাই। উৎসবে আমরা যে চারটি চলচ্চিত্র দেখেছি, তাতে ড. সহিদ উল্যাহর কথাই স্পষ্ট হয়েছে।
সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘ব্যাটল অব আলজিয়ারস’ নিয়ে ড. মো. মোরশেদুল আলম লিখেছেন, ‘ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের আন্দোলনের বাস্তবধর্মী বিবরণ তুলে পনটিকরভোর এ–ছবি ঔপনিবেশিক শাসনকে তীব্র সমালোচনা করে। বিশ্বে এ পর্যন্ত নির্মিত চলচ্চিত্র সমূহের মধ্যে অন্যতম সেরা হিসেবে এটি বিবেচিত।’
মনিরুল মনির লিখেছেন তাঁর প্রবন্ধে (ওসমান সেমবেনে ও আফ্রিকা : ‘বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়’) : ‘ সেমবেনে লিখেছেন, সিনেমা বানিয়েছেন। মার্ক্সীয় রাজনীতিতে মনোনিবেশ করলেন। ফরাসি শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলনের ভেতর থেকে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। মস্কো গিয়ে সিনেমা বানানো শিখলেন। তার প্রতিবাদী রূপ শুরু সেই স্কুল বেলায়। স্কুল শিক্ষকের চাপে ঔপনিবেশিক সুর গাইতে পারবেন না। স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়ে গেলেন। তার পিতা মৎস্যকর্মী। পিতার সাথে নানারকম পেশায় যুক্ত হয়ে গেলেন। হরেকরকম পেশায় সেমবেনে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সৃজন কর্মকে বয়ে নিয়ে গেলেন’।
ডিপ ফোকাস–এর আফ্রিকান চলচ্চিত্র উৎসব সংখ্যাটির প্রতিটি লেখা চমকপ্রদ, তথ্যসমৃদ্ধ। আফ্রিকান চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্র এবং অনুভূতি নিয়ে লেখাগুলো নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করবে আমাদের জ্ঞানের বহরকে। পরিশেষে চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনা উপহার দেয়ার জন্য। আশা করি, ভবিষ্যতেও ‘ডিপ ফোকাস’ নিয়মিত প্রকাশ করে চলচ্চিত্রমোদীদের আশা পূরণ করবে।