গত ১৪ নভেম্বর পালিত হলো বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন এ দিবসটির পালনের উদ্যোগ নেয়, জাতিসংঘ এ উদ্যোগে একাত্মতা ঘোষণা করে। পরে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৪ই নভেম্বর এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে পৃথিবীর সব ক’টি দেশ প্রত্যেকটি বছরে ১৪ নভেম্বরে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মূলত এ দিনটি ইনসুলিনের আবিষ্কারক ফ্রেডরিক বেন্টিং এর জন্মদিন। যিনি ১৯২৩ সালে এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। ডায়াবেটিস পৃথিবীতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ২০১৯ সালের হিসাব মতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৪৬৩ মিলিয়ন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এটি ৫৭৮ মিলিয়ন এ পৌঁছবে। এর মধ্যে ৮৮ মিলিয়ন বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রতি ১১ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ২ জনের মধ্যে একজনই জানেন না, যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি ৪ জনে ৩ জনই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে বাস করেন। ২০১৯ সালে ডায়াবেটিসে প্রায় ৪.২ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গড়ে প্রতি ৬টি সন্তান প্রসবের ১টি মায়ের ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত। স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ১০% এর বেশি এই রোগের পেছনে ব্যয় হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রতি রোগীর পরিবারের সদস্যের অংশ জরুরি।
বাংলাদেশে যেমন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি, তেমনি ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হারও বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে উঠে আসবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, যেমন বাংলাদেশ, ভারত ।
বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ণ , সুষম খাদ্যের গ্রহণের তারতম্যের কারণে মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাং্ঙ্িখত হারের চেয়ে বেশি। কায়িক পরিশ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লক্ষ,যা মোট জনসংখ্যার ৮.১%(সূত্র-ওহঃবৎহধঃরড়হধষ উরধনবঃরপং ঋবফবৎধঃরড়হ -০৩.০৩.২০২০)
যদিও এ বিষয়ে তেমন কোন ডাটা নেই, তবে ধারণা করা হচ্ছে, চট্টগ্রামে প্রতিদিন নতুন করে শনাক্ত হচ্ছে ১০০-১৫০ জন, যাদের মধ্যে মধ্য বয়সী রোগীর সংখ্যা বেশি। এবং প্রতি ৭ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে ।
শিশুদের যে ডায়াবেটিস হয়,তা সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঞুঢ়ব-১ ,যেখানে শিশুর অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে শিশুদের মধ্যে ঃুঢ়ব-২, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার প্রবণতা ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা সাধারণত প্রাপ্ত বয়স্কদের বেশি হয়। শিশুদের ঃুঢ়ব-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ স্থুলতা।এছাড়া ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস থাকা ও অলস জীবন যাপন ও এর জন্য দায়ী। আজকাল অনেক বাচ্চাই স্মার্ট ফোনের বিভিন্ন গেমস এ আসক্ত। দিনের বেশিরভাগ সময় টেলিভিশন ও কম্পিউটারের সামনে কাটিয়ে দেয়।কোভিড ১৯ প্যানডেমিকে বাসায় বসে অনলাইন ক্লাস করায় এদের অনেকেরই ওজন বেড়ে যাচ্ছে। বাহিরের খোলা মাঠে খেলাধুলা করার প্রবণতা কমে গিয়েছে।এছাড়া যত্রতত্র এপার্টমেন্ট, শপিংমল গড়ে উঠাতে আগের মতো খেলার মাঠও নেই। ফাস্ট ফুডের অতি সহজ লভ্যতায় বাচ্চারা এসব খাবারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এসব নানাবিধ কারণে বাচ্চাদের স্থ্থলতা বেড়ে যাচ্ছে। স্থুলতা ইনসুলিনকে সঠিকভাবে কাজ প্রদানে বাধা দেয়। যার ফলে পরবর্তীতে এই বাচ্চাগুলো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। প্রকারভেদে ডায়াবেটিসের কারণ বিভিন্ন রকম।
ঞুঢ়ব-১ ডায়াবেটিসে শরীরে নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের অগ্ন্যাশয়ের বিটা সেলের (ইবঃধ পবষষ) বিরুদ্ধে কাজ করে তা নষ্ট করে দেয়-ফলে ইনসুলিনের অভাবে ডায়াবেটিস দেখা দেয়। কিন্তু ঃুঢ়ব-২ ডায়াবেটিসের কারণ নানাবিধ। অতিরিক্ত স্থুলতা, অলস জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস, জিনগত সমস্যা এসব গুলোর কোন না কোন প্রভাবে এধরনের ডায়াবেটিস হয়। এছাড়া গর্ভবস্থায় প্লাসেন্টা থেকে কিছু হরমোন আসে, যা ইনসুলিনের কাজকে বাধা প্রদান করে, ফলে মহিলাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়। প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, ফাস্ট ফুড ও অতিরিক্ত ক্যালরি যুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে, ধূমপান পরিহার করতে হবে, রক্তের গ্লুকোজ,চর্বির মাত্রা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। গর্ভবস্থায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিতের পাশাপাশি ওজন বৃদ্ধি গ্রহণ যোগ্য মাত্রায় রাখতে হবে।
এ বছরের প্রতিপাদ্য-্থডায়াবেটিস সেবার পার্থক্য আনতে পারে নার্সরাই্থ। বিশ্বের সকল স্বাস্থ্যকর্মির মধ্যে ৫৯ শতাংশই নার্স। এই বিশাল পেশাজীবী শ্রেণীকে ডায়াবেটিস শিক্ষার আওতায় আনা গেলে, তারাও রোগীদের মাঝে এ শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারবেন, যা ডায়াবেটিস মহামারী প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। একজন ডায়াবেটিক রোগীর ডায়াবেটিস শিক্ষা ও সচেতনতায় একজন নার্সের ভূমিকাকে বিশেষ ভাবে তুলে ধরার জন্যই এটি এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়।
একজন নার্সকে জানতে হবে ডায়াবেটিসের লক্ষণ,এর প্রতিরোধে করণীয় এমনকি ডায়াবেটিক রোগীর খাদ্য ব্যবস্থা জীবন যাপন প্রণালী ও চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং এর দীর্ঘ মেয়াদি জটিলতা। তবেই তিনি অন্যকে এ বিষয়ে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। ডায়াবেটিক জনগোষ্ঠীর সচেতনতায় নার্সের ভূমিকা কে বিশেষ ভাবে তুলে ধরাই এই প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য ।একই সাথে সারা বিশ্বের নার্স সংকট নিরসনের প্রতি ও গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এই উপলক্ষে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ উরধনবঃরপ ভবফবৎধঃরড়হ (ওউঋ) এর স্কুল অব ডায়াবেটিস এর ওয়েবসাইটে ‘একজন ডায়াবেটিস প্রশিক্ষকের ভূমিকা’ শীর্ষক ১ ঘণ্টার একটা অনলাইন কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কোর্সটি বিনামূল্যে করা যাবে। আশা করি, এ কোর্সের মাধ্যমে তারা নিজেদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ তা রোগীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারবে, এবং ডায়াবেটিস সেবা ও প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। এজন্য আমাদের দেশেও নার্স সংকট সমাধানে সংশ্লিষ্ট সকলের এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।