ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে একজন রোগীকে দিনে একাধিকবার ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। তাই ডায়াবেটিস চিকিৎসায় বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত ইনসুলিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ডায়াবেটিস চিকিৎসার খরচ, ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন গ্রহণ, ইনসুলিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এ চিকিৎসাকে জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ করে তুলেছে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা সহজ ও সাশ্রয়ী করার লক্ষ্যে মুখে খাওয়ার ওষুধ আনতে একটি গবেষণা চলছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী। খবরটা আমাদের জন্য পরম আনন্দের। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা যায়, ডায়াবেটিসের চিকিৎসাসংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে বাংলাদেশ, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার একদল বিজ্ঞানী অনেক দিন থেকেই গ্লুকাগন-লাইক পেপটাইড-১ (জিএলপি-১) নামের একটি হরমোন নিয়ে গবেষণা করছেন। এ গবেষণা দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ট্রান্সপোর্টেশন, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং হ্যানিয়াং ইউনিভার্সিটিতে পরিচালিত হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কলোরায়ার তরুণ গবেষক শাতিল শাহরিয়ার। তাঁদের গবেষণার মূল লক্ষ্য, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের এমন কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করা, যা ইনজেকশনের মাধ্যমে না দিয়ে মুখে খাওয়ার বড়ি বা ক্যাপসুলের মতো সেবন করা যায়। এমন একটি ওষুধ আবিষ্কার করা, যা খুব অল্প মাত্রায় দীর্ঘদিন কাজ করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং তাঁদের মধ্যে ৮০ ভাগ রোগী অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করেন। এ ৮০ শতাংশ মানুষের অর্ধেকই ডায়াবেটিসের নিয়মিত চিকিৎসা নিতে পারেন না।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, মানবশরীরের ডায়াবেটিস রোগের অনুরূপ ডায়াবেটিস জিনগতভাবে প্রতিস্থাপিত তিনটি পৃথক জাতের একাধিক ইঁদুরের ওপর গবেষণা করে প্রিক্লিনিক্যালের সব পর্যায়ে সাফল্য আসে। পরে মানবদেহের সঙ্গে ৯৩ শতাংশ ডিএনএ মিল আছে, এমন বানরের ওপর গবেষণায় সফলতা পাওয়া গেছে বলে জানান গবেষকেরা।
সমপ্রতি আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কোষের জিএলপি-১ রিসেপ্টর সক্রিয় করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এমন দুটি প্রতিষেধক ট্রুলিসিটি ও ট্যানজিয়ামকে স্বীকৃতি দিয়েছে। শাতিল শাহরিয়ারদের গবেষণা বলছে, প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে জিএলপি১ আমেরিকার এফডিএ কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিষেধক ট্রুলিসিটির ইনজেকশনের চেয়ে সাত গুণ বেশি কার্যকর বলে দেখা গেছে। কারণ, একবার সেবনে ডায়াবেটিক বানরে জিএলপি ১ কমপক্ষে ১৪ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ট্রুলিসিটি বানরের শরীরে স্থির থাকে দুই দিন। গবেষকদের দাবি, জিএলপি১ মানুষের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এক মাস পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ইঁদুর, বানর ও মানবদেহের বিভিন্ন কোষের ওপর গবেষণা করে জানা গেছে, এ ওষুধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানবদেহে ইনসুলিন নামক হরমোনের ঘাটতি হলে কিংবা উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে ব্যবহৃত না হলে অথবা শরীরের ইনসুলিন নিষ্ক্রিয় থাকলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এ গ্লুকোজ পরে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থার নামই ডায়াবেটিস। একবার কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে সারাজীবন তাকে এ রোগ বহন করতে হয়। তবে টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সুতরাং সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্য ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
খুশির খবর, সারাদেশে ব্যাপক সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও ওষুধ বিনামূল্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে বিনামূল্যে ইনসুলিন মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে সরকার। এর অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে দেশের চারটি উপজেলায় এনসিডিসি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকেও রয়েছে ডায়াবেটিস শনাক্তের ব্যবস্থা। শনাক্ত হওয়া রোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও ওষুধ। একই সঙ্গে এক লাখ ইমামকে সচেতনতায় যুক্ত করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকে ২০০ মানুষকে সচেতন করতে পারলেও দুই কোটি মানুষ উপকৃত হবে। এ ছাড়া নিয়মিত উঠান বৈঠকেও মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা, বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ প্রদানসহ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর নতুন গবেষণা আমাদের মনোবল বাড়াতে ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে। এই গবেষণা ডায়াবেটিস চিকিৎসায় আশা পথ দেখাবে।