সুনীতিভূষণ কানুনগো ১৯৩৪ এর ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগো পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা পুলিন বিহারী কানুনগো ও মাতা সুচারু প্রভা কানুনগো। পুলিন বিহারী কানুনগো ছিলেন স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, উপমহাদেশের স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ্ ড. কালিকারঞ্জন কানুনগো তাঁর জ্যৈষ্ঠপিতৃব্য।
নিজ গ্রামেই শৈশব–কৈশোর এর শিক্ষা শেষ করে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৬০ সালে আধুনিক ইতিহাস এম.এ এবং ১৯৭২ সালে পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ পাশ করে বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়ায় নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন টগবগে এক তরুণ। ১৯৬১ সালে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে যোগদেন নিজ গ্রামের স্বনামধন্য ঐতিহাসিক স্যার আশুতোষ কলেজে। পিতৃব্য প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কালিকারঞ্জন কানুনগোর নির্দেশনা ও আর্শিবাদ পেয়েছিলেন তিনি। ডাকযোগে পত্রমারফত শিশুর মতো অনুসন্ধিৎসা আর যুকিডাইসের মতো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নিয়ে চার পাশের জগত থেকে লেখার উপাদান খুঁজে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁকে।
জীবন চলার পথের শুরুর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬২ সালে আমার শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠ পিতৃব্য অধ্যাপক কালিকারঞ্জন কানুনগো নির্দেশ দিলেন আমি যেন গবেষণা কর্ম আরম্ভ করি। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্র এবং শিক্ষকতার পদে উত্তরাধিকারী অধ্যাপক আবদুল হালিমের নিকট চিঠি দেন। কিছু পরেই আমার পিতৃব্য আমার বিষয় নিয়ে তাঁর বন্ধুদ্বয় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. কাজী মোতাহের হোসেনের নিকট চিঠি দেন। সে সময়ে প্রফেসর আবদুল করিম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দ্বিতীয়বারের পিএইচডি ডিগ্রির জন্য প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জে বি হ্যারিসন সাহেবের তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত আমার গবেষণা কর্মের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক হালিম পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুতরাং সক্রিয়ভাবে আমার কাজের তত্ত্বাবধান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় আমার পক্ষে অথৈ জলে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। ড. হালিমের পরামর্শে ড. আহমদ হাসান দানীর সাথে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ড. দানী তখন একাডেমিক কাজে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, আমার মত একজন আনাড়ি গবেষককে প্রাথমিক শিক্ষাদান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সৌভাগ্যের বিষয় প্রফেসর করিম (তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার) ঢাকা প্রত্যাবর্তন করলে আমি অনতিবিলম্বে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ কাতে যাই। প্রফেসর করিমের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ আমার জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। পরপর দুটো ডক্টরেট ডিগ্রির অধিকারী হয়েছেন তিনি, অতি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় রীডারের পদে উন্নীত হয়েছেন, (সে সময় ডক্টরেট ডিগ্রি না থাকলে সহযোগী অধ্যাপক দূরের কথা সহকারী অধ্যাপকও হওয়া যেত না) সল্লিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের পদ লাভ করেছেন। মাসে প্রায় হাজার টাকা রোজগার করছেন। চোখেমুখে তাঁর সাফল্যের দীপ্তি। বিভাগীয় শিক্ষকদের সাথে বসেছিলেন তিনি। নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছিল তাঁদের মধ্যে। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। একটু পরে কক্ষে প্রবেশ করলাম। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার যে, অধ্যাপক হালিম অসুস্থ হবার পর থেকে অধ্যাপক কবির ও অধ্যাপক করিমকে বিভাগীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদন করতে হতো। ফলে অধ্যাপক করিমের অফিস ত্যাগ করতে প্রায়ই একটু দেরি হয়ে যেত। আমি তাঁর এই বিলম্বের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ তখন মেডিকেল কলেজের একপাশে অবস্থিত ছিলো। দোতলার তিনটি কক্ষ ব্যবহৃত হতো। যা হৌক সিনপসিসটা দেখালাম। বেশ খুশি হলেন তিনি। বললেন, ঠিক আছে সিনপসিসটা অনুসরণকরে কাজ আরম্ভ করে দিন।
‘গবেষণা পদ্ধতির প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা তাঁর হাস্যোদ্রোক করলেও কোন সময়েই তিনি বিরক্ত প্রকাশ করেন নি। কিন্তু সাধারণ ছুটির দিনে কিংবা কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করা আমার পক্ষে ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সকৃতিভূষণ কানুনগো (পরবর্তীতে বিজ্ঞানি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স এবং এমএসসি অধ্যয়নকালে চার বছর তাঁর কাছে গিয়ে থাকবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু অধ্যয়ন শেষে সে গবেষণার জন্য দেশত্যাগ করলে আমি ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখীন হলাম। ১৯৬৪ সালে আমার থিসিসের প্রথম ড্রাফট লেখা শেষ হলো। প্রফেসর করিম আমার থিসিসটা পড়ে উপযুক্ত সংশোধন করবার পরামর্শ দিয়ে ফেরৎ দিলেন।’
সুনীতিভূষণ কানুনগোর বর্ণনামতে তাঁর বিকশিত হওয়ার পিছনে যিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি হলেন বরেণ্য ইতিহাসপ্রবক্তা চট্টগ্রামের আলোকিত ড. আবদুল করিম।
ইতিমধ্যে ১৯৬৬ এর ১৮ নভেম্বর স্থাপিত হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগ দেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক এ আর মল্লিক। চারটি বিভাগ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ ছিল অন্যতম। প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ে ইতিহাস বিভাগের প্রথম বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন প্রফেসর করিম। সাথে নিয়ে এলেন প্রিয় শিষ্য সুনীতিভূষণ কানুনগোকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ‘আ হিষ্ট্রি অব চিটাগাং আন্ডার মুসলিম রুল’ (A History of the muslim rule in chittagong) বিষয়ে আতসন্দৎ রচনা করে পিএইডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
জীবনের দীর্ঘকাল সময় শিক্ষকতা জীবন শেষে ১৯৯৯ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। রেডক্লিফ ভারতের বুকে চুরি চালিয়ে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করেন। পেন্সিলে আকাঁ ভৌগলিক সীমারেখা পূর্ব বাংলার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিজভূমে পরবাসীতে পরিণত করে। পূর্ব পুরুষের শত বছরের পুরনো ঘর, ভিটে মাটি সব ছেড়ে পাড়ি দেয় অজানা অন্য এক দেশে। কানুনগোপাড়ার আবেগে সেই তরুণ সেদিন সেই জনস্রোতে ভেসে যাননি। কোনো ভয় তাকে টলাতে পারেনি। সেই কলকাতা নগরীতে তিনি গেলেন না। তিনি বলেন তিনি এ মাটির সন্তান জন্মভূমির মায়া তাঁকে জড়িয়ে রাখে। তাঁকে ছাড়তে পারেনি কোনভাবেই। এই মাটিতেই জীবন অতিবাহিত করে গেলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকা অবস্থায় এবং অবসর পরবর্তী সময়ে তিনি নিয়মিত লিখেছেন অসংখ্য প্রকাশনা রয়েছে তাঁর। তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থাবলীর একটি তালিকা এখানে তুলে ধরছি।
(১) A History of Chittagong (Vol I and II)(এ হিস্ট্রি অব চিটাগাং, ভলিউম–১ ও ২) (২) বাংলার ইতিহাস (১ম,২য় ও ৩য় খণ্ড), (৩) বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস (১ম ও ২য় খণ্ড), (৪) দি চিটাগাং রিভোলট–১৯৩০–৩৪, (৫) বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম, (৬) এ হিষ্ট্রি অব দি চিটাগাং হিলট্রেক্স : চাকমা রেজিট্যাল্স ট্রান্স ইন ব্রিটিশ ডমিনেশন, (৭) ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির সংগ্রাম, (৮) বাংলার বৈষ্ণব আন্দোলন, (৯) বাংলার ভক্তিবাদ, (১০) প্রাচ্যের রাষ্ট্র, দর্শন, (১১) কালিকারঞ্জন কানুনগো, (১২) জীবন ও কর্ম মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, (১৩) জীবন ও কর্মঃ শরৎ চন্দ্র দাশ, (১৪) জীবন ও কর্মঃ নবীন চন্দ্র দাশ, (১৫) জীবন ও কাব্যঃ চর্চা (১৬) চট্টগ্রাম চরিতাভিধান, (১৭) ইংল্যান্ডের ইতিহাস, (১৮) পার্বত্য চট্টগ্রাম : ইতিহাস ও সামজ সংস্কৃতি, (১৯) প্রাচীন হরিকেল রাজ্য, (২০) মধ্য চট্টগ্রামের ইতিবৃত্তি, (২১) চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ।
অপ্রকাশিত গ্রন্থাবলী হলো, (১) আত্মকথা, (২) পটিয়ার ইতিহাস, (৩) চট্টগ্রামের রেনেসাঁস আন্দোলনে মুসলিম সমাজের ভূমিকা, (৪) বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলন প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে তাঁর অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ। বাংলা ও ইংরেজি দু’মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলার রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস। বিপ্লব ও বিপ্লবীদের ইতিকথা, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের জটিল সব বিষয়কে তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। তিনি কেবল একজন শিক্ষক আর গবেষকই শুধু নন। তিনি একজন মহান সাধক হিসেবে নিরবে নিভৃতে জীবনের পুরোটা সময় কাজ করেছেন। তিনি কোন সময়ই তাঁর কাজের স্বীকৃতি চাননি, অযাচিত যে কোন পুরস্কার তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখান করে গেছেন।
জীবনের শেষ বেলায় তাঁর প্রবন্ধ গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ‘চট্টগ্রাম একাডেমি শিল্পশৈলী’ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২, প্রদান করেছেন। অসুস্থ শরীরে তিনি উপস্থিত থেকে এ পুরস্কার গ্রহণ করে পুরস্কারটিকে সম্মানিত ও গৌরবদীপ্ত করেছেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী