ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

চট্টগ্রামের মেগা-প্রকল্পগুলোর অর্থনৈতিক উপকার পেতে সময় লাগবে

| বৃহস্পতিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ

শেখ হাসিনার আমলে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। আরো কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন কিংবা কয়েকটির বাস্তবায়নের পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। নিবন্ধে এগুলোর অর্থনৈতিক সুফল পেতে হলে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, প্রকল্পগুলোর ব্যয় যৌক্তিক কিনা অথবা প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ কতখানি বিশ্বাসযোগ্য এসব ব্যাপার বিশ্লেষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো হলো: কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, চট্টগ্রামকক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প, চট্টগ্রাম আউটার রিংরোড প্রকল্প, বায়েজিদ লিংক্‌রোড প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো হলো কালুরঘাটচাক্তাই রিংরোড প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মীরসরাই শিল্পনগরী এবং কালুরঘাট সেতু প্রকল্প। পরিকল্পনাধীন মেগাপ্রকল্পগুলো হলো বেটার্মিনাল প্রকল্প, মীরসরাইকক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প এবং ঢাকানারায়ণগঞ্জকুমিল্লাচট্টগ্রাম কর্ডলাইন প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সুফল এবং ব্যয়বাহুল্য নিয়ে নিবন্ধে আলোচনা করছি।

) কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প: ২০২৩ সালের অক্টোবরে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় কর্ণফুলী টানেলই নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল। আমার বিশ্বাস, দীর্ঘমেয়াদে এই টানেলের সুদূরপ্রসারী ও বহুলবিস্তৃত ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভূত উপকার সাধন করবে। অবশ্য এটাও বলা প্রয়োজন, প্রাথমিক ভাবে বেশ কয়েক বছর টানেলটি একেবারে স্বল্পব্যবহৃত থাকবে বিধায় টানেলটির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ যানবাহনের টোল থেকে উঠে আসবে না। গত এক বছরে রক্ষণাবেক্ষণখরচের একচতুর্থাংশও যানবাহনের টোল থেকে উঠে না আসার ব্যাপারটি ফলাও করে বেশ কয়েকবার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে প্রায় আঠারো হাজার যানবাহন প্রতিদিন টানেল ব্যবহার করবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল সেক্ষেত্রে বাস্তবে ব্যবহার করছে মাত্র চার হাজার যানবাহন। সেজন্য, সাধারণ জনগণের কাছে এই প্রকল্পটিকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ‘সাদা হাতি প্রকল্প’ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। বলা হচ্ছে, টানেল প্রকল্পটি সাবেক হাসিনা সরকারের ‘প্রেস্টিজ প্রকল্প’ কিংবা দুর্নীতির খাই মেটানোর জন্য গৃহীত ও বাস্তবায়িত আরেকটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। বিশেষত, ৪৫০ কোটি টাকায় আনোয়ারা প্রান্তে নির্মিত ‘সাত তারকা মানের রিসোর্ট’ এই প্রকল্পটির অপচয়ের প্রতীক হিসেবে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় তাহলো, টানেলটি নির্মাণের জন্য মোট ১০,৩৭৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে যে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে, সে ঋণ পরিশোধের বার্ষিক কিস্তি ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশের জন্য বড়সড় বোঝা হিসেবে চেপে বসছে। প্রথম কয়েক বছর টানেলের টোলের আয় থেকে ঋণের বার্ষিক কিস্তির অর্থ পরিশোধ করা তো দূরের কথা, টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ সরকারী বাজেট থেকে বেশ কয়েক কোটি টাকা প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে। কিন্তু, নিচের বিষয়গুলোর গুরুত্বকে খাটো করা যাবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা থেকে কর্ণফুলী নদীর মোহনা পর্যন্ত কুড়ি কিলোমিটার এলাকায় নদীতে কোন সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই। বিষয়টিকে বিবেচনায় নিলে দীর্ঘমেয়াদী সুফলের বিবেচনায় কর্ণফুলী টানেলের আবশ্যকতাকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের পটিয়া ও আনোয়ারা হয়ে সাংগু নদীর দক্ষিণে অবস্থিত বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজারের অন্যান্য এলাকায় চট্টগ্রাম নগরী থেকে সড়কপথে যাতায়াতের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার বেড়ে যাচ্ছে এই ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে। কর্ণফুলী টানেল এতদঞ্চলের এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে চিরতরে দূর করে দিয়েছে। যথাযথ নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করলে কর্ণফুলী টানেল দীর্ঘমেয়াদে চট্টগ্রাম নগরীকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনস’ এ পরিণত করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। উপরন্তু, চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকটি জেটি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে নির্মাণের সুযোগও সৃষ্টি হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড স্থাপিত হয়ে গেছে, চীনের ইকনমিক জোন স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। টানেলের পার্শ্ববর্তী আনোয়ারায় অবস্থিত কর্ণফুলী সার কারখানা এবং চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা টানেলের ফলে সরাসরি পরিবহনব্যয় ও সময়সাশ্রয়ের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে, এবং আনোয়ারার পারকী সমুদ্রসৈকত একটি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠছে। অতএব, আগামী সাতআট বছর টানেলের সীমিত ব্যবহার ও হতাশাজনক আয়ের বিষয়টিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দেওয়াই যৌক্তিক। পতিত স্বৈরাশাসক হাসিনা সকল মেগাপ্রজেক্টকে পুঁজিলুন্ঠনের মওকা হিসেবে অপব্যবহার করায় টানেলের নির্মাণব্যয় হয়তো অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়ে গেছে। এক দশকের লোকসান সত্ত্বেও পরবর্তী যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার জন্য টানেলটির অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

) চট্টগ্রামকক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প: অর্থনৈতিক বোঝা হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামদোহাজারীকক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প নিয়েও। ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মসূচির অধীনস্থ ‘বিসিআইএম ইকনমিক করিডোর’ যখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তোড়জোর চালু ছিল তখন বাংলাদেশকে মিয়ানমার হয়ে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং নগরীর সাথে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু, ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ‘বিসিআইএম ইকনমিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠার চুক্তি থেকে সরে গেছে। অতএব, এখন রেলপথটি কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। এই রেলপথটিও অদূর ভবিষ্যতে ‘আন্ডারইউটিলাইজড’ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই প্রকল্পে অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য, কক্সবাজার যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটননগরী তাই দীর্ঘমেয়াদী সুফলের বিবেচনায় এই রেললাইন প্রকল্পটিকে অপ্রয়োজনীয় বলা যৌক্তিক হবে না।

) চট্টগ্রাম আউটার রিংরোড প্রকল্প: এই প্রকল্পটি পতেঙ্গা সৈকত থেকে সাগরতীর বরাবর চট্টগ্রামঢাকা মহাসড়ক পর্যন্ত নির্মাণের কথা থাকলেও এখনো প্রায় ছয় কিলোমিটার সড়ক দু’লেইনের রয়ে যাওয়ায় সড়কের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। বরং, প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই ছয় কিলোমিটারে অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছে। আশা করি, এই ছয় কিলোমিটারের নির্মাণকাজ অবিলম্বে বাস্তবায়িত হবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই রিংরোডের পার্শ্বে পরিকল্পিত বেটার্মিনাল নির্মিত হলে সড়কটিকে ছয় বা আট লেইনের মহাসড়কে রূপান্তরিত করতেই হবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে সড়কটিকে আট লেইনের মহাসড়কে রূপান্তরের প্রকল্প গ্রহণ বাঞ্ছনীয় মনে করছি।

) বায়েজিদ লিংকরোড প্রকল্প: এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ায় চট্টগ্রাম নগরীর যানজট উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। তবে, মহাসড়কটির বেশ কয়েকটি স্থানে দু’পাশের পাহাড়গুলোকে যে খাড়াভাবে কাটা হয়েছে সেটা মোটেও পরিবেশবান্ধব হয়নি। তাই, বর্ষাকালে এসব জায়গায় ভূমিধসে প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। উপরন্তু, মহাসড়কটি যেখানে চট্টগ্রামঢাকা মহাসড়কের সাথে মিলিত হয়েছে সেখানে উপযুক্ত ইউটার্ন বা ফ্লাইওভার নির্মাণ না করায় জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।

) চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: চট্টগ্রাম নগরীর লাল খান বাজার থেকে এয়ারপোর্টের নিকটস্থ জায়গা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেও মাঝখানে যথাযোগ্য স্থানে পরিকল্পিত প্রায় সবগুলো ওঠানামার র‌্যাম্প নির্মাণের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এটি ব্যবহারকারীদেরকে তেমন সুফল দিচ্ছে না। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ র‌্যাম্প নির্মাণকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিচ্ছে কিনা সে প্রশ্নও করতেই হচ্ছে।

) কালুরঘাটচাক্তাই রিংরোড প্রকল্প: এই প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। এটি অত্যন্ত ভাল একটি প্রকল্প, যা চট্টগ্রাম নগরীর যানজট অনেকখানি কমিয়ে দেবে। একইসাথে, এই প্রকল্পে প্রায় ১২টি স্লুইজগেট নির্মিত হচ্ছে, যা চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যাকেও অনেকখানি কমিয়ে দেবে। সম্ভাব্য উপকারিতার বিবেচনায় এই প্রকল্পটি চট্টগ্রাম নগরীর জন্য ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিশেষত, ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত আউটার রিংরোড ও বায়েজিদ লিংক রোডের সাথে যুক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রাম নগরীর অভ্যন্তরীণ যানজট নিরসনে এই মহাসড়কটি বিরাট অবদান রাখবে।

) মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর: মাতারবাড়ী কক্সবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল হলেও এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটাবে। দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর হতে যাচ্ছে এটি। দেশের অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে এটি ‘গেমচেঞ্জার’ হয়ে উঠবে।

) মীরসরাই শিল্পনগরী: এটি দেশের সর্ববৃহৎ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল হতে যাচ্ছে, যার আয়তন সীতাকুন্ডু, মীরসরাই ও ফেনী পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ৩৪,০০০ একর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এই শিল্পনগরীতে বৈদেশিক বিনিয়োগের গতি বেশ খানিকটা কমে গেলেও নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এর আকর্ষণ হয়তো ফিরে আসবে।

) কালুরঘাট সেতু প্রকল্প: কর্ণফুলী নদীর ওপর মহাগুরুত্বপূর্ণ এই সেতু নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে জনগণ আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। বহুবছর ধরে দীর্ঘসূত্রতার জটাজালে বন্দী কালুরঘাট রেলকামসড়ক সেতুর নির্মাণকাজ দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে কয়েক মাস আগে শুরু হয়েছে, যা দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে চট্টগ্রাম নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। গত দু’দশক ধরে এই সেতু নির্মাণে সরকার আশ্বাস দিলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস মাত্র কয়েক মাস আগে এই সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছেন।

১০) বেটার্মিনাল প্রকল্প: অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, বেশ কয়েকবছর আগে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বেটার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও স্বৈরশাসক হাসিনার খামখেয়ালিপনার শিকার হয়ে বেটার্মিনাল প্রকল্পটি দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়েছে। এই টার্মিনালে প্রায় ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে বলা হচ্ছে, যা বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলোতে সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারার সীমাবদ্ধতাকে অনেকখানি দূর করবে। বিশেষত, শেখ হাসিনার খামখেয়ালিপনার প্রতীক পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের অবাস্তব প্রকল্পে দেদার অর্থঅপচয়ের কারণেই হয়তো বেটার্মিনাল নির্মাণের বিষয়টি বারবার পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়াসে প্রকল্পটিতে কিছুটা গতিসঞ্চার হলেও এখনো এই মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির শনির দশা কেটেছে কিনা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু, চট্টগ্রাম বন্দরের পঙ্গুত্ব লাঘবে বেটার্মিনাল অত্যন্ত জরুরী ভূমিকা পালন করার বিষয়টি সর্বজনবিদিত।

১১) মীরসরাইকক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক: কর্ণফুলী টানেলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যবহার নিশ্চিত হবে যখন নির্মীয়মাণ মীরসরাই শিল্পনগরী থেকে বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত ‘মেরিন ড্রাইভ’ সড়ক এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ সম্পন্ন হবে। প্রস্তাবিত মেরিন ড্রাইভটি মীরসরাই থেকে কর্ণফুলী টানেল পর্যন্ত ছয় লেনের সড়ক এবং টানেলের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হিসেবে নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বলে খবর দেওয়া হয়েছে সরকারীভাবে। এই মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পটি মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি সুবিশাল আবাসন ও শিল্পায়ন জোন গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মীয়মাণ গভীর সমুদ্রবন্দরের বহুলবিস্তৃত ও যথাযথ অর্থনৈতিক উপযোগিতা এবং ব্যয়সাশ্রয় সংক্রান্ত উপকার পেতে হলে এই মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পটি অগ্রাধিকার সহকারে গড়ে তুলতেই হবে। এই মেরিন ড্রাইভটি কর্ণফুলী টানেলকেও ‘অপটিমামলেভেলে ব্যবহারের’ পথকে সুগম করে দেবে।

১২) ঢাকানারায়ণগঞ্জকুমিল্লাচট্টগ্রাম কর্ডলাইন প্রকল্প: এই প্রকল্পটির বেশিরভাগ কাজ চট্টগ্রামের বাইরে হলেও চট্টগ্রামের জন্য প্রকল্পটির গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। কারণ, ট্রেনে ঢাকাচট্টগ্রাম ভ্রমণকে অত্যন্ত যুগোপযোগী ও সময়সাশ্রয়ী করে তুলবে এই প্রকল্প। ঢাকাচট্টগ্রামের ট্রেনভ্রমণ থেকে ৬৩ মাইলের দূরত্ব কমিয়ে দেবে এই রেললাইন। প্রয়োজনে এই রেললাইনটি চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যুৎচালিত আধুনিক প্রযুক্তির রেলপথ হিসেবে নির্মাণ করা অযৌক্তিক হবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রায় শেষ করে এনেছে বলে জানা যাচ্ছে।

উপরে যেসব প্রকল্পের বর্ণনা দেওয়া হলো সেগুলোর মধ্যে স্বৈরশাসক হাসিনার আমলে বাস্তবায়িত কয়েকটি প্রকল্পে অভাবনীয় দুর্নীতি হয়েছে বলে জনগণের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। আশা করি, বাস্তবায়নাধীন এবং পরিকল্পনাধীন প্রকল্পগুলো এই পুঁজিলুন্ঠনের মহাযজ্ঞ থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকবে। প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, কিন্তু লুটেরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের লুন্ঠনের খাই মেটানোর জন্য প্রকল্প অপব্যবহৃত হওয়ার ‘কালচার’ থেকে জাতি যদি নিষ্কৃতি পায় তাহলে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধগাজার পানে দুর্নিবার যাত্রা: ‘ব্যর্থ’ সুমুদ ফ্লোটিলার পালে স্বাধীনতার হাওয়া
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৮