২০০৮ সালের পর শুরু হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব–একাধিপত্যের পতনের ধারা। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর গত ৮০ বছর ধরে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব–আধিপত্য (হেজিমনি)। ১৯৪৫–১৯৯১ পর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে, যার ফলে ঐ পর্বে মার্কিনীদের আধিপত্য কোন দেশেই ‘আনচ্যালেঞ্জড একাধিপত্যে’ পরিণত হতে পারেনি। প্রায় সব দেশেই ঐ পর্বে সরকার পরিবর্তনের পেছনে হয় মার্কিন হস্তক্ষেপ নয়তো সোভিয়েত সহযোগিতা কার্যকর থাকতো। কিন্তু, ঐ পর্বে লাতিন আমেরিকায় কিউবা ও নিকারাগুয়া ছাড়া অন্য কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠতে দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বেশ কয়েকটি লাতিন আমেরিকার দেশে বেশ কয়েকবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ আগ্রাসন কিংবা গোপন ক্যু–দেতার কারণে সেসব সরকারের পতন ঠেকানো যায়নি। গ্রানাডায় সরাসরি মার্কিন সেনাবাহিনী সরকারের পতন ঘটিয়েছে, আবার চিলিতে সিআইএ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সালভাদোর আলেন্দেকে হত্যা করে সরকারকে উৎখাত করেছে। নিকারাগুয়ায় সান্দিনিস্তা সরকারকে সিআইএ উৎখাত করলেও তারা আবার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। বলা হয় যে লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশে সামরিক একনায়কদেরকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে ঐ সময় সিআইএ’র কালোহাত প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতো। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও রাষ্ট্রক্ষমতার পট–পরিবর্তনে প্রায়ই মার্কিন অথবা ফ্রান্স ও বৃটেনের গোপন ভূমিকা থাকতো ঐ পর্বে। এতদ্সত্ত্বেও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ১৯৪৫–৯১ পর্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫০–৫৩ এর কোরিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা আজো টিকে রয়েছে। ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে ফ্রান্সকে, কিন্তু ১৯৫৫ সালে আবার মার্কিন পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দক্ষিণ ভিয়েতনামে জেঁকে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে, কুড়ি বছর ধরে ভিয়েতনামে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম উত্তর ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মহারক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। প্রায় কুড়ি লাখ ভিয়েতনামীর মৃত্যুর বিনিময়ে ঐ যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল ভিয়েতনাম, লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৫ সালে পালাতে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। ঐ সময় কাম্পুচিয়া এবং লাওসেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলেও মার্কিনীরা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চীনের ঐ রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নেয়নি। (১৯৭১ সালে চীন সফরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন চীনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে)। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা সত্ত্বেও। আশির দশকে পোলান্ডে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সফল হওয়ায় পূর্ব ইউরোপের সকল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সংগ্রামের মাধ্যমে ডমিনো স্টাইলে ভেঙে পড়ে সমাজতন্ত্র। সবশেষে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ঘোষণা করে রাশিয়া। এসব পরিবর্তনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালোহাত প্রতিটি ক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিল।
আশির দশক ও নব্বই দশকের এই ঐতিহাসিক প্রতিবিপ্লবের ধারার কারণে মনে করা হয়েছিল, সমাজতন্ত্র ক্রমশ বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মার্কিনীরা বিশ্বের একক সুপারপাওয়ারে পরিণত হয়। কিন্তু, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে সমাজতান্ত্রিক মডেলগুলোর পতন শুরু হওয়ার আগেই অথবা সমসাময়িক কালে চীন ১৯৭৮ সালে ও ভিয়েতনাম ১৯৮৬ সালে তাদের সমাজতান্ত্রিক মডেলগুলোয় যুগোপযোগী পরিবর্তন সাধন করে উন্নয়নকে তরান্বিত ও টেকসই করায় চমকপ্রদ সফলতা অর্জন করতে সমর্থ হয় । সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতান্ত্রিক মডেল যে একসময় স্থবিরতায় আক্রান্ত হবে সে বাস্তবতা উপলব্ধি করে চীনে ১৯৭৮ সালে অভূতপূর্ব বিপ্লবী–সংস্কার কার্যক্রম গৃহীত হয়, যেখানে কৃষিখাতে আবার ‘ফ্যামিলি রেসপনসিভিলিটি সিস্টেম’ চালু করে সম্পত্তির ওপর জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে আনা হয়, অন্যদিকে সারা দেশের শহর ও গ্রামগুলোতে ‘টাউনশিপ এন্ড ভিলেজ এন্টারপ্রাইজ’ (টিভিই) চালুর মাধ্যমে সীমিত পরিসরে প্রাইভেট এন্টারপ্রিনিয়রশিপ ও সমবায় কার্যক্রম অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হয়। চীনে কয়েক লক্ষ টিভিই গড়ে উঠেছে গত চল্লিশ বছরে, যেগুলো ক্রমেই প্রাইভেট খাতের সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উন্নয়নের এক চমকপ্রদ মডেলে পরিণত হয়েছে। একইসাথে, চীন প্রবল ও সুদূরপ্রসারী প্রণোদনা দিয়ে বৈদেশিক পুঁজি ও বহুজাতিক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীনে আমন্ত্রণ জানায়। সারা বিশ্ব থেকে অভূতপূর্ব দ্রুততায় চীনে ছুটে আসে বহুজাতিক পুঁজিবাদী বিনিয়োগ। চীন গ্রহণ করে রফতানিমুখী শিল্পায়নের একটি চমকপ্রদ মডেল, যেখানে রাষ্ট্র সুপরিকল্পিতভাবে রফতানি খাতে প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের পথের সকল বাধাবিঘ্ন দূর করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। গত তিন দশক ধরে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। বলা হয়, অধিকাংশ শিল্পের ক্ষেত্রে চীন এখন ‘বিশ্বের ফ্যাক্টরি”। অথচ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তাখাতে চীন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বহাল রেখে দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টিকে রুখে দাঁড়ায়। পাশাপাশি, অত্যন্ত সুচতুর পরিকল্পনার মাধ্যমে চীনের রাষ্ট্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দ্রুত উন্নতি সাধনের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে চীন। এর ফলে, অর্থনীতির ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ ২০২৫ সালেও বহাল রয়ে গেছে রাষ্ট্রের মালিকানায়, বাকি ৫০ শতাংশের ওপর প্রাইভেট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কোন রকমের বাধা খাড়া করেনি রাষ্ট্র। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এই নতুন মডেলের বাস্তবায়নে চীন রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণকে এতটুকুও শিথিল করেনি, অর্থনীতির ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণও পুরোপুরি অটুট রয়ে গেছে। তারা এই মডেলকে নাম দিয়েছে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’। ২০০৮ সালের মধ্যেই চীন দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণে শতভাগ সফলতা অর্জন করে, এখন চীনে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে। আইএমএফ ঘোষণা করেছে, ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের নিক্তিতে ২০১৪ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের তারতম্য বিবেচনায় নিয়ে প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে যে ২০৩১ সালের মধ্যেই নমিনাল জিডিপি’র নিক্তিতেও চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে ‘বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতিতে’ পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে।
অন্যদিকে, ভিয়েতনাম প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতা–যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে ১৯৭৫ সালে। তিন দশকের চরম–বিধ্বংসী স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে ঐ সময় ভিয়েতনাম বাংলাদেশের মত বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচিত হত। বিশ্বের জনগণের কাছে ভিয়েতনাম হলো সবচেয়ে বেশি রক্ত–ঝরানো স্বাধীনতা–যুদ্ধে বিজয়ী দেশ। সমাজতন্ত্রী ভিয়েতনাম বিশ্বের একমাত্র দেশ যে দেশটি বিশ্বের দু’দুটো সুপার–পাওয়ার ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে নিজেদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে, ফ্রান্স পরাজয় বরণ করেছে ১৯৫৪ সালে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম যখন স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল তখন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’—সুকান্তের এই অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য ভিয়েতনামের বীর জনগণের ক্ষেত্রে। যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে স্বাধীন ভিয়েতনামকে মার্কিনীরা অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পঙ্গু রাখারও ব্যবস্থা করেছে দুই দশক। এতদ্সত্ত্বেও ভিয়েতনাম কখনোই কোন দেশের কাছে মাথা নত করেনি, ভিক্ষার জন্যে হাত পাতেনি। এমনকি, অনুদান ও ‘সফট লোনের’ আশায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি। অথচ, কী দারুণ কষ্টকর ছিল ১৯৭৫–পরবর্তী বছরগুলোতে ভিয়েতনামের জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার, ১৯৮৫ সালে ছিল ২৮৫ ডলার। ২০২৫ সালে আইএমএফ এর প্রাক্কলন মোতাবেক ভিয়েতনামের মোট জিডিপি ৪৯০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালে ভিয়েতনামের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ৪৮০৬ ডলারে পৌঁছে গেছে, যেটাকে ‘মিরাকল’ বলা হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৪ সালে পৌঁছে গেছে ১৭,৪৮৪ পিপিপি ডলারে। ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৮.৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে ভিয়েতনামের মাত্র ২ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছে। ১৯৮৬ সালে ভিয়েতনামও ‘দোই মোই’ বা রিনোভেশন নাম দিয়ে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার ৩৯ বছর পর এখন পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন–চিন্তকরা ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে ‘সোসালিস্ট–ওরিয়েন্টেড মার্কেট ইকনমি’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। ‘দোই মোই’ কর্মসূচিতে ‘কালেকটিভ ফার্মিং’ নিষিদ্ধ হয়েছে, জমির ওপর জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ উভয়কে উৎসাহিত করা হয়েছে। ‘দোই মোই’ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান তিনটি ডাইমেনশান হলো: ১) অত্যন্ত শক্তহাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উদারীকরণ, ২) অত্যন্ত দ্রুত অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বি–নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারী হস্তক্ষেপ হ্রাসের মাধ্যমে ব্যবসা করার খরচ ও বাধাবিঘ্ন কমিয়ে ফেলা এবং ৩) রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ প্রবলভাবে জোরদার করার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন (শিক্ষা) ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রথম অগ্রাধিকারে পরিণত করা। বিশেষত, প্রাইমারী শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই তার পুরো জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত করে তুলেছে এবং জনগণের বিশাল একটি অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল করে তুলেছে। একইভাবে উল্লেখযোগ্য যে ভিয়েতনাম তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈষম্য তেমন একটা বাড়তে দেয়নি। ভিয়েতনামের জনগণের শতভাগ ২০২৫ সালে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় সেবা পেয়ে চলেছে। জনসংখ্যা নীতির ব্যাপারে ভিয়েতনাম কঠোরভাবে ‘দুই সন্তান নীতি’ অনুসরণ করে চলেছে। আয় ও সম্পদ বৈষম্যের ক্ষেত্রেও ভিয়েতনাম অত্যন্ত সযতনে বৈষম্যবৃদ্ধির প্রবণতাকে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলকে কয়েকটি নগরে কেন্দ্রিভূত না করে ভিয়েতনাম গ্রামীণ জনগণের মাঝে উন্নয়নের সকল ডাইমেনশানকে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। বৈদেশিক বিনিয়োগকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করে চলেছে ভিয়েতনাম। স্যামসাং, এল জি, অলিম্পাস, পাইওনিয়ার—এসব কোম্পানির দক্ষিণ–পূর্ব এশীয় হাব এখন ভিয়েতনামে। এখন ভিয়েতনামে প্রতি বছর বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ দাঁড়াচ্ছে ২০–২৫ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনামের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রয়ে গেছে, কিন্তু ব্যাংকঋণে উদ্যোক্তাদের অভিগম্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে সহজ ও বহুলবিস্তৃত করা হয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতার পেছনের চাবিকাঠি হলো ভিয়েতনামে দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম, ভিয়েতনামের শ্রমশক্তি ও মানবপুঁজি বাংলাদেশের চাইতে অনেক শিক্ষিত, দক্ষ এবং পরিশ্রমী। ভিয়েতনামের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন চমকপ্রদ। বন্দর, মহাসড়ক ও সুলভ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম দ্রুত আধুনিকায়নে সফল একটি দেশ। তৈরী পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম এখন বাংলাদেশকে হটিয়ে মাঝে মাঝে গণচীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানটি দখল করে নিচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে এখন সিঙ্গাপুরের পর ভিয়েতনাম দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। চাল রপ্তানিতে থাইল্যান্ডকে হটিয়ে ভিয়েতনাম ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ব্রাজিলের পর কফি রপ্তানিতে ভিয়েতনাম বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সাড়ে নয় কোটি জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামের মোট রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। ২০২৪ সালে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ছিল ৪০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (স্যামসাং একাই ভিয়েতনামের রফতানি আয়ের এক–চতুর্থাংশ নিয়ে আসছে)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গণচীনের চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে গণচীনে উৎপাদনরত অনেক শিল্পকারখানা এখন ভিয়েতনামে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ভিয়েতনাম থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টিতে। উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের ক্ষমতায়ন এবং গ্রাম–সমবায়ের ক্ষেত্রেও ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে। সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতন্ত্রকে যে যুগোপযোগী সংস্কার করতেই হবে, এটা বুঝে নিয়েই ভিয়েতনাম ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে বুঁদ না হয়েও যে ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের’ মাধ্যমে অর্থনৈতিক ‘মিরাকল’ ঘটানো সম্ভব, সেটারই অকাট্য প্রমাণ ভিয়েতনাম।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়