২০২২ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপের প্রকাশিত প্রাথমিক ফলাফলে বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি (বা জিনি) সহগের মান নির্ধারিত হয়েছে ০.৪৯৯। অতএব, এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশ একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে এসে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণকারী একটি দেশ উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার মানে হলো দেশটি হাইজ্যাক হয়ে শ্রমজীবী জনগণের মালিকানার দেশ থেকে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের করায়ত্ত ‘শোষকের দেশে’ পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বেড়ে দেশটি একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে তা আমরা কিছুতেই মেনে নেবো না। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮–১৯ অর্থ–বছরে ৮.১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০–২২ পর্বে করোনা ভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ৫ শতাংশের কাছাকাছি ছিল এবং ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আবার ৫.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অতএব এটা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে।
কিন্তু, মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ–মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠির কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। দুঃখজনকভাবে আশির দশক থেকেই এদেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়ে গেছে। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ এবং গিনি (বা জিনি) সহগ অন্যতম। কোন অর্থনীতির গিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন বুঝতে হবে যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক বাংলাদেশের গিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছিল ০.৪৮৩, যা ১৯৭৩ সালে ছিল মাত্র ০.৩৬। ২০২২ সালের খানা আয়–ব্যয় জরিপে গিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছে ০.৪৯৯ (মানে ০.৫ এর একদম কাছাকাছি)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র–ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট–২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ধনকুবের ছিল ২৫৫ জন।। ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে ত্রিশ মিলিয়ন বা তিন কোটি ডলারের (৩২৫ কোটি টাকা) বেশি নীট–সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে ‘আল্ট্রা–হাই নেট–ওয়ার্থ’ (ইউ এইচ এন ডব্লিউ’) ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অতএব, শেখ হাসিনার বর্তমান মন্ত্রীসভায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সংখ্যাধিক্য কিংবা সংসদ সদস্যদের ৬২.৭ শতাংশ ব্যবসায়ী হওয়াকে কাকতালীয় বলা যাবে না। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সরকার পালাক্রমে এদেশে গত ৩২ বছরের মধ্যে ৩০ বছর সরকারে আসীন থাকলেও দেশে আয়বৈষম্য বৃদ্ধিতেই তারা ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ঐতিহাসিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সংবিধানে সমাজতন্ত্র ফেরত এসেছে। কিন্তু, নামকাওয়াস্তে সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হলেও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ–ব্যাপারে কিছুই করছে না। এর দুটো কারণ আন্দাজ করা যায়: প্রথমত, আওয়ামী লীগ নব্বই দশকের শুরুতেই সমাজতন্ত্রের স্থলে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠাকে তাদের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্র এখন আর রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় নয়।
সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছানোর জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারীকরণ হয়ে গেছে; ৪) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫) দেশের জায়গা–জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৬) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ৭) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটিতে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৮০ লাখ মানুষ বস্তীবাসী; ৮) দেশে গাড়ী, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়ীঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে। আবার অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের সন্তানদের জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার হিড়িক চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবেলা করা দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন, কারণ আয় ও সম্পদ পুনর্বন্টন খুবই কঠিন রাজনৈতিক নীতি–পরিবর্তন ছাড়া অর্জন করা যায় না। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, গণচীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইসরায়েল এবং মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্র নানারকম কার্যকর আয় পুনর্বন্টন কার্যক্রম গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিনি সহগ বৃদ্ধিকে শ্লথ করতে বা থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যদিও সাম্প্রতিক বিশ্বে জিনি সহগ কমানোর ব্যাপারে কিউবা ছাড়া অন্য কোন দেশকে তেমন সাফল্য অর্জন করতে দেখা যাচ্ছে না। এই দেশগুলোর মধ্যে কিউবা, গণচীন ও ভিয়েতনাম এখনো নিজেদেরকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, বাকি দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য–নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে।
আয়বৈষম্য নিরসনের জন্যে করণীয়: প্রথমত, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও জালিয়াতি–মুক্ত নির্বাচনে জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধিরা যাতে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত সকল নির্বাচনে নির্বাচিত হতে পারেন সে ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই হবে। জনগণের কাছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিক জবাবদিহি যাতে নিশ্চিত করা যায় তার জন্য ‘রিকল’ ব্যবস্থাকেও প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে হবে। পরবর্তী কর্তব্য হলো, ‘বাজার ব্যর্থতা’ কেন হয় তা ভালভাবে বুঝে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে যৌক্তিকভাবে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। বাজার ব্যর্থ হয় গরীবের মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, ব্যর্থ হয় পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে, ব্যর্থ হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলায়, ব্যর্থ হয় নানারকম মনোপলী ও অলিগোপলীর কারণে, ব্যর্থ হয় গণদ্রব্য বা ’পাবলিক গুড’ যোগান দিতে। মূল কথা হলো, রাষ্ট্রকে বৈষম্য নিরসনকারীর ভূমিকা নিতেই হবে, যে রকম করা হয়েছে ভিয়েতনামে, গণচীনে কিংবা কিউবায়। তৃতীয়ত, সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে প্রধানত সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের আয়কর ও সম্পত্তি কর থেকে। সরকারী ব্যয়ের প্রধান অগ্রাধিকার দিতে হবে বৈষম্যহীন ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষায়, গরীবের জন্য ভালমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলায়, মানসম্পন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে, গরীবের খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে। চতুর্থত, যেখানে সুযোগ থাকে সেখানেই কৃষক সমবায় সমিতি গড়ে তুলে কৃষককে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যদাম পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং শ্রমজীবী জনগণকে ন্যায্য মজুরী পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে রাষ্ট্র কঠোর অভিভাবকের ভূমিকা নেবে। যেখানে সম্ভব সেখানে গণচীন ও ভিয়েতনামের মত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা শ্রমিক সমবায় সমিতিগুলোর হাতে প্রত্যর্পণের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গণচীনের Township and Village Enterprise (TVE) মডেল এক্ষেত্রে অনুকরণীয় হতে পারে। পঞ্চমত, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন, ইত্যাদি পাবলিক ইউটিলিটিজ সরবরাহ ক্রমশ ব্যক্তিখাতে ছেড়ে দিয়ে সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারে সেজন্যে সরকারকে কঠোর দাম–নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যান্য ব্যক্তিখাতের বিক্রেতারাও যাতে জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্রকে কঠোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি, ২০১১ সালে সংবিধানে সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে পুনর্বহাল হলেও একুশ শতকের বাস্তবতায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ‘রাষ্ট্রতন্ত্র’ (স্টেটিজম) এবং একদলীয় পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে মডেলগুলো বিংশ শতাব্দীর আশির ও নব্বইয়ের দশকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেছে সেগুলোকে আর ফেরত আনা যাবেনা। বিংশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক বিপ্লব–প্রতিবিপ্লবের ঘটনাগুলো থেকে যে বিষয়টা সামনে চলে এসেছে তাহলো, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি খাত ও বাজারকে প্রতিপক্ষ অবস্থানে ঠেলে দেওয়া যৌক্তিক নয়। বাজার এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা হওয়া উচিত পরিপূরকের। কিছু কাজ বাজার ও ব্যক্তিখাত ভালো করবে, আর কিছু কাজ রাষ্ট্র ভালো করবে। কতগুলো বিষয়ে বাজার ব্যর্থ হবে, আবার ব্যক্তি খাতের অক্ষমতা ও বাজার ব্যর্থতা (মার্কেট ফেইল্যুর) থেকে মুক্তির আশায় রাষ্ট্রের হাতে ঐ বিষয়গুলো অর্পণ করা হলে রাষ্ট্রব্যর্থতা (স্টেট ফেইল্যুর) ও দুর্নীতি এড়ানো কঠিন হবে। রাষ্ট্র ও বাজারের পরিপূরক ভূমিকাকে মেনে নিয়ে এই দুটো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্ধারণের সঠিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। বাজার ও রাষ্ট্রের যৌক্তিক ভূমিকা নির্ধারণের যে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট গণচীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইসরায়েল, নিকারাগুয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, এল সালভাদর, ইকুয়েডর ও কিউবায় প্রযুক্ত হয়ে চলেছে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মানে, জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তামূলক ও বৈষম্য–নিরোধক কার্যক্রম, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ—এ ধরনের গণমুখী খাতে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অপরদিকে, প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পত্তি করের মাধ্যমে সরকারী রাজস্বের সিংহভাগ আহরণ করে ঐ পুনর্বন্টনমূলক সরকারী ব্যয়ের অর্থায়ন করতে হবে। ফলে, শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং বিকাশমান ব্যক্তিখাত ও সুশাসিত বাজারের (মড়াবৎহবফ সধৎশবঃ) সমন্বয়ে ক্রমেই উন্নয়নের সফল মডেল হয়ে উঠবে দেশ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রাষ্ট্র যদি প্রতিরক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সিভিল প্রশাসনের মত অনুৎপাদনশীল খাতে সরকারী ব্যয় ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয় তাহলে যে ব্যয় সাশ্রয় হবে তা দিয়ে উপরে উল্লিখিত সামাজিকভাবে কাম্য কার্যক্রমগুলোতে রাষ্ট্র অর্থবহ সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হবে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়