আমার মনে হচ্ছে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভারত আবার ভেটো দিয়েছে। ২০২৩ সালের শুষ্ক মৌসুমেও তিস্তা প্রকল্প প্রস্তাবটি একনেকে উপস্থাপিত না হওয়ায় নিশ্চিত হওয়া গেলো যে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের ভেটোকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকার এ–ব্যাপারে আর কোন পদক্ষেপ নেবে না। বহুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় করা একটি খবর ছিল প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রবল আপত্তির মুখে সেটা অনুমোদনের জন্য একনেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। গত ২০২২ সালে একটি খবর সরকারী মহল থেকেই প্রচার করা হয়েছিল যে ঐ আপত্তি সত্ত্বেও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। কিন্তু, এরপর দীর্ঘদিন সরকারী পক্ষের আর কোন নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগ জানে, ভারত সরকার বাংলাদেশের নির্বাচনকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। তাই, ভারতীয় ভেটো যে এবারও তিস্তা প্রকল্পকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে দিল সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
প্রায় পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প প্রণয়নের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বে বহুল–পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে ঐ একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প–প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সাথে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়, বাংলাদেশও ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করে।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে দশ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একইসাথে, রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ–কাম–রোড নির্মাণ করে নদীর দু’তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে সেচখাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। উপরন্তু, নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ন সুবিধাদি গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনা জেনে আমার মনে হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যিসত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য–পীড়িত উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে। আমি প্রকল্প–প্রস্তাবের অনুমোদন–প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সেজন্যই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। (অবশ্য একদল বিশেষজ্ঞ তিস্তা প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ হবে না বলে মত ব্যক্ত করে চলেছেন)। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটির অনুমোদন হয়ে যাবে। কিন্তু, খবর নিয়ে জানা গেল এই প্রকল্পে বাগড়া দিচ্ছে ভারত। ভারত নাকি এই প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকে তাদের দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ঘোষণা করে বাংলাদেশকে প্রকল্প বাতিল করার জন্য সরাসরি চাপ দিয়ে চলেছে। ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেকের’ এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েক’শ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থানকে ভারত মেনে নেবে না। অতএব, বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছে।
একটা নদীখনন প্রকল্পে নিয়োজিত চীনা প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানরা ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে দাবি করলে সেটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য? যে এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেখান থেকে ‘শিলিগুড়ি চিকেন নেক করিডর’ অনেক দূরে। তিস্তা নদীর দক্ষিণ–পূর্বদিকের ভাটিতে যতই প্রকল্পের কাজ এগোবে ততই বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব বাড়তে থাকবে। একবার শোনা গিয়েছিল, ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কীয় উদ্বেগকে আমলে নিয়ে সীমান্ত–নিকটবর্তী ১৬ কিলোমিটার নদীর খনন বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করবে। আমার মতে প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভারতের ভেটো ‘ক্লাসিক দাদাগিরি’, যে ধরনের ‘দাদাগিরি’ দেখিয়ে তারা ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর ভেটো দিয়ে চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় নির্মিতব্য গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি ভন্ডুল করে দিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে একটি ভাল বিকল্প গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় এখন জাপানের অর্থায়নে ঐ বন্দরের নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত–বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকার জন্য মহাগুরুত্ববহ তিস্তা প্রকল্পটি ভন্ডুল করার জন্যে মোদী সরকার এহেন ‘আঞ্চলিক দাদাগিরি’ (regional hegemony) চালিয়ে যাচ্ছে। অতএব, যে প্রশ্নটির জবাব আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মহলকে দিতেই হবে তাহলো ভারতের এহেন দাদাগিরির কাছে নতজানু হওয়ার জন্য কি ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? শেখ হাসিনা কি ভয় পাচ্ছেন যে ভারতের এসব অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করলে আগামী নির্বাচনে ভোট উল্টে দিয়ে ভারত তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে? ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র, কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার কোন অধিকার ভারতের থাকতে পারে না। ভারতের অন্যায় চাপাচাপি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সীমা–লংঘন, যা প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালির জন্য মর্যাদাহানিকর।
ভারতের কাছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক কোন দিক্ থেকেই বাংলাদেশ নির্ভরশীল নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনভাবেই ভারতের দয়া–দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর খয়রাত–নির্ভর লজ্ঝর অবস্থানে নেই। এদেশটি এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দেশের আমদানী বিল রপ্তানী আয়ের চাইতে এখনো বেশি থাকায় যেটুকু বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে তা মেটানোর জন্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ২০২০ সাল পর্যন্ত যথেষ্ট প্রমাণিত হচ্ছিল। গত দু’বছর ধরে অবশ্য আমাদের বাণিজ্য–ঘাটতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের সমস্যায় পড়েছি আমরা। ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানির বার্ষিক প্রবাহ বার বিলিয়ন ডলারের মত, অথচ বাংলাদেশ থেকে ভারতে বছরে রপ্তানি হয় মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য। উল্টোদিকে, বাংলাদেশে যেসব ভারতীয় অভিবাসী কর্মরত রয়েছে তারা প্রতি বছর আরো প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স হুন্ডির মত অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতে পাঠাচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ, ভারত থেকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য রেমিট্যান্সই আসে না। এমনকি, বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগকেও এখনো উল্লেখযোগ্য বলা যাবে না। তাহলে বারবার ভারত তাদের সংকীর্ণ ভূ–রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য কীভাবে বাংলাদেশের নীতি–প্রণেতাদের হাত মোচড়ানোর ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে? চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত–বিরোধ সত্ত্বেও ভারত চীনের সাথে ২০২২ সালে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বাণিজ্য চালিয়েছে। অথচ, বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীন থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিতে গেলেই ভারত বারবার নানা অজুহাতে বাগড়া দিয়ে চলেছে। আমাদের জানা আছে যে ভারত বাংলাদেশকে নানা প্রকল্পে যে ঋণ–সহায়তা অফার করেছে সেগুলো এতই কঠিন শর্ত–কন্টকিত যে বাস্তবে বাংলাদেশ ঐ ‘টাইড এইডের’ অতি–ক্ষুদ্রাংশই গ্রহণ করেছে। এগুলোকে আর দশটা ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের’ চাইতে বেশি সুবিধাজনক আখ্যায়িত করার কোন যুক্তি নেই। এসব ঋণের আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ‘কানেকটিভিটি’ বাড়ানো, এখানে কোন দয়া–দাক্ষিণ্যের ছিটেফোঁটাও নেই। মজার ব্যাপার হলো, একসময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ অভিবাসী কিংবা শরণার্থীর যে বিপুল প্রবাহের অভিযোগ তুলে ভারত শোরগোল বাধিয়ে দিত এখন ঐ শরণার্থী–স্রোতের অস্তিত্ব্ব আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং, প্রায় দু’লাখ ভারতীয় এখন বাংলাদেশে কাজ করছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ভারতীয় গরুর ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা যে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে সেটাও এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন গরুর মাংস উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। (ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন বাংলাদেশী মুসলিমদেরকে গরুর গোশত্ খাওয়ার অভ্যাস ভুলিয়ে ছাড়বেন বলে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সেটা বোধ হয় তাঁর জীবদ্দশায় ঘটবে না)!
তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী, যার বন্যার কবলে পড়ে প্রায় প্রতি বছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে। আবার, শুষ্ক মৌসুমে তুলনামূলকভাবে খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতাহেতু সেচসুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকে। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। বর্তমান ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতেও তিস্তার পানিস্বল্পতার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গজলডোবা ব্যারেজের উজানে অতি শীঘ্র আরো দুটো খাল খনন করবে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়, এলাকার জনগণের জীবন ও জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদী। বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও একটি আন্তর্জাতিক নদীর উজানে এহেন একতরফা বাঁধ নির্মাণ কিংবা খাল খননের আগে ভারত একবারও বাংলাদেশের সাথে আলাপ–আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং, দীর্ঘ তিন দশকের কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে যখন ২০১১ সালে দু’দেশ তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। সম্প্রতি গজলডোবা ব্যারেজের উজানে মমতা ব্যানার্জীর সরকার আরো দুটো সেচখাল খননের প্রকল্প গ্রহণ করায় বোঝা যাচ্ছে, যদ্দিন মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন তদ্দিন বাংলাদেশের সাথে ভারতের তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কোন সম্ভাবনা নেই।
দুটো সার্বভৌম দেশের সম্পর্ক একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতার কাছে জিম্মি হতে পারে না। অথচ ভারত এই অজুহাতেই এক যুগ ধরে এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখেছে। অবশ্য, তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। তিস্তা চুক্তি হোক্ বা না হোক্ তিস্তা প্রকল্প ঐ অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এতদঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে তার তো কোন সমাধান হবে না! প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থায় ব্যবỊত হলে এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলবে। এই প্রকল্পের বিভিন্ন ডাইমেনশানের বর্ণনা জানাজানি হওয়ার পর এলাকার জনগণের মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন গেড়ে বসেছিল, খুশিতে মাতোয়ারা হয়েছিল তারা। প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়নের জন্য দেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মানব–বন্ধন ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, তাদের অপেক্ষা সহজে ফুরোবে না! লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়