মাথাপিছু জিডিপি সমান হলেও ভারতে
জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশ থেকে কম
সম্প্রতি আইএমএফ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুকে’ ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি’র হিসাবে বাংলাদেশ ভারতকে টপকে যাবার পূর্বাভাস প্রদানের কারণে সারা বিশ্বের উন্নয়ন-চিন্তার জগতে ঝড় উঠেছে, এবং এটা নিয়ে ভারতের মিডিয়ার আঁতে ঘা লাগায় প্রবল তোলপাড় শুরু হয়েছে। আইএমএফ এর পূর্বাভাস বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২০১৯ সালের ২১০০ ডলার থেকে ১৮৭৭ ডলারে নেমে যাবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ৩.৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে মাথাপিছু জিডিপিকে ১৮৮৮ ডলারে নিয়ে যাবে। ভারতীয়দের ‘সুপেরিয়রিটি কমপ্লেঙ’ ও মিথ্যা অহমিকা-প্রসূত ‘ইগো’ এ-পূর্বাভাসের ফলে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কিছুদিন আগে বাংলাদেশীদেরকে ‘উইপোকা’ বা ‘ঘূণ’ বলে তাচ্ছিল্য করার পর বাংলাদেশীদের মাথাপিছু জিডিপি ভারতীয়দের মাথাপিছু জিডিপি’কে টপকে যাওয়ার সম্ভাবনা হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের অনেকের মারাত্মক বদহজম ও অনিদ্রা-ব্যামোর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, এটা শুধু এক বছরের করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত নয়। পাঁচ বছর আগেও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চাইতে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ভারতের চাইতে অনেক বেশি হয়েছে। আমি অবশ্য এটা নিয়ে অতি-উচ্ছ্বসিত হবো না। পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে এখনো ভারতের প্রাক্কলিত মাথাপিছু জিডিপি ৬২৮৪ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের ৫১৩৯ পিপিপি ডলার। এর মানে, ভারতে বেশিরভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশের চাইতে কম হওয়ায় ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চাইতে উঁচু। বক্ষ্যমাণ কলামে আমি বিষয়টা ব্যাখ্যা করব। (অবশ্য, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবকৃত মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি এবং পিপিপি ডলারে মাথাপিছু জিডিপি’র অনেক পার্থক্য রয়েছে।)
প্রথমেই ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ বা ‘ক্রয়ক্ষমতার সাম্য’ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করছি। বিশ্বের দেশে দেশে যেহেতু বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম কম-বেশি হয় সেজন্য বিভিন্ন দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তরিত করা হয়। এটা একটা যুগান্তকারী গবেষণার ফসল, কিন্তু পদ্ধতিটি বেশ টেকনিক্যাল হওয়ায় সাধারণ পাঠকদের কাছে বিষয়টি জটিল মনে হবে। (কমপিউটার প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণেই পদ্ধতিটির প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে।) এই পদ্ধতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক’শ পণ্য ও সেবার দামকে তুলনার একক হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশে একই পণ্য ও সেবাগুলোর দাম কতখানি বেশি বা কম তার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের মুদ্রার অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতাকে মার্কিন ডলারের ক্রয়ক্ষমতার তুলনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ফলে, যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে বেশি সেই দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপিকে কমিয়ে আনা হয়, এবং যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে কম সে দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপিকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সাধারণভাবে যেসব দেশের মাথাপিছু জিডিপি কম সেসব দেশে অধিকাংশ পণ্য ও সেবার দামও তুলনামূলকভাবে কম হয়, এক্ষেত্রে ভারত এবং বাংলাদেশের ব্যাপারটা অনেকখানি ব্যতিক্রম। নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সহ বেশিরভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশে ভারতের চাইতে বেশি। খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা–যেগুলোকে ‘মৌল চাহিদা’ বলা হয় সেগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশে ভারতের চাইতে বেশি। উদাহরণ: ১) চাল, আটা, ময়দা, মশলাপাতি, তরিতরকারী, ডালসমূহ, মুরগি, ডিম, দুধ, মাখন, চিনি সবই ভারতে বাংলাদেশের চাইতে সস্তা; ২) শার্ট, ট্রাউজার, জিনস্, টি-শার্ট ও জুতো-স্যান্ডেল ছাড়া নারী-পুরুষ-কিশোর-কিশোরী-শিশুর কাপড়-চোপড় ভারতে বাংলাদেশের চাইতে সস্তা; ৩) ভারতে কমপিউটার সহ অধিকাংশ ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চাইতে কম, মোবাইল টেলিফোনে কল অবশ্য বাংলাদেশে সস্তা; ৪) ভারতে বিদেশি গাড়ি খুব বেশি ব্র্যান্ডের পাওয়া না গেলেও ভারতে উৎপাদিত গাড়ির দাম বাংলাদেশে আমদানি করা গাড়ির তুলনায় অনেক কম; ৫) ভারতের বেশিরভাগ শহরে এবং গ্রামে জমি-জমার দাম বাংলাদেশের চাইতে কম; ৬) ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলো ব্যতীত অন্যত্র অধিকাংশ নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চাইতে কম, তাই এপার্টমেন্ট বা পাকা বাড়ির দাম/নির্মাণ খরচও কম; ৭) ভারতের শিক্ষা-খরচ প্রাইমারী থেকে উচ্চতম লেভেল পর্যন্ত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশের কাছাকাছি হলেও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা-খরচ বাংলাদেশে ভারতের চাইতে বেশি; ৮) স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা খরচ ভারতে বাংলাদেশের তুলনীয় পর্যায়ে হলেও এসব সেবার মান ভারতে উন্নততর; এবং ৯) ভারতে বাস, ট্রেন, টেঙি ও প্লেনের ভাড়া বাংলাদেশের তুলনায় কম। আরো অনেক আইটেম পিপিপি পদ্ধতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আমি জনগণের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কিছু পণ্য ও সেবাকে তুলনার জন্য উল্লেখ করেছি মূল কথাটা বলার জন্য: ভারতের মাথাপিছু জিডিপি এদ্দিন বাংলাদেশের চাইতে বেশি হলেও জীবনযাত্রার ব্যয় ভারতে বাংলাদেশের চাইতে কম হওয়ায় ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৬২৮৪ পিপিপি ডলার এবং বাংলাদেশের ৫১৩৯ পিপিপি ডলার। এখন দু’দেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি সমপর্যায়ে চলে আসলেও ভারতের জনগণ ভোক্তা হিসেবে বাংলাদেশীদের চাইতে অনেক সুলভে ও স্বচ্ছন্দে জীবন নির্বাহ করতে পারছেন। (পিপিপি পদ্ধতির অনেকগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেগুলো আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে যত্ন সহকারে বুঝিয়েছি। কিন্তু, পাঠকদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না বলে সেগুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলাম না।)
মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন্ দেশে বেশি পাচ্ছে তা জানতে দু’দেশের বিদ্যমান আয় ও সম্পদবৈষম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এ-ব্যাপারে দু’দেশের তুলনা বেশ কঠিন। শুধু এটুকু বলবো, ২০১৬ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম এন্ড এঙপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক বাংলাদেশের আয়বৈষম্য-পরিমাপকারী জিনি সহগ বেড়ে ০.৪৮৩ এ পৌঁছে গেছে। (১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩৩।) এর মানে এখন বাংলাদেশ উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আরেকটি পরিমাপকের গতি-প্রকৃতির মাধ্যমে ২০১০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে আয়বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে এবং ৫-১০ শতাংশ ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ফুটে উঠেছে: ২০১০ সালে দরিদ্রতম ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ০.৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে মাত্র ০.২৩ শতাংশে নেমে গেছে। ২০১০ সালে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা মাত্র ১.০১ শতাংশে নেমে গেছে। সমস্যার আরেক পিঠে দেখা যাচ্ছে, দেশের ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর দখলে ২০১০ সালে ছিল মোট জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আরো দুঃখজনক হলো, জনগণের সবচেয়ে ধনাঢ্য ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর দখলে ২০১৬ সালে চলে গেছে মোট জিডিপি’র ২৭.৮৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এঙ’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি-ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। ভারত এ-ব্যাপারে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন না হলেও ধনকুবেরের সংখ্যা সেখানেও ক্রমশ বাড়ছে। আর, এটারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেঙে’ বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫ এর চাইতে ভারতের অবস্থান ১৯ ধাপ পেছনে ৯৪ নম্বরে চলে যাওয়ার ব্যাপারটায়। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, সিকিম, সেভেন সিস্টার্স (আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও মিজোরাম) সহ অধিকাংশ রাজ্যের প্রায় আশি কোটি জনগণের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি এবং পিপিপি ভিত্তিতে পরিমাপকৃত মাথাপিছু জিডিপি উভয়ই বাংলাদেশের চাইতে অনেক কম। আঞ্চলিক আয়বৈষম্য বাংলাদেশেও রয়েছে, তবে ভারতের মত অতো প্রকট নয়।
জাতির ‘অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম’ সফল করার জন্যে আমাদের সুকঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে আরো বহুবছর। এই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে এখন প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে জাতির উন্নয়নের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুন্ঠন এবং বিদেশে পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে। এখন আর আমাদের কোন ঔপনিবেশিক প্রভুদেশ নেই। এখনকার পুঁজি লুটেরারা এদেশের ক্ষমতাসীন মহল ও তাদের আত্মীয়-স্বজন, দুর্নীতিবাজ আমলা ও সামরিক অফিসার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা। রাষ্ট্রক্ষমতাকে অপব্যবহার করে এই লুটেরারা অবৈধ ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে ৪৯ বছর ধরে। জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক এই তিনটি ‘গজব’। ২০০৭-৮ সালের সামরিক-বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত এদেশের ৪৯ বছরের কোন সরকারই দুর্নীতি ও পুঁজি লুন্ঠনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি। নয়তো অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক আগেই আমরা ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে পারতাম। পলাতক পুঁজি (পধঢ়রঃধষ ভষরমযঃ) সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনাকারী সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানাচ্ছে যে এখন প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৭-৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এদেশের আমদানীকারক ব্যবসায়ীরা, গার্মেন্টস মালিকরা, রাজনীতিক ও তাদের স্বজনরা, দুর্নীতিবাজ আমলা, সামরিক অফিসার ও প্রকৌশলীরা এবং ব্যাংকের রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা বেধড়ক লুন্ঠনের মাধ্যমে অবৈধ ধন-সম্পদ আহরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, সুইজারল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে পুঁজি পাচার করে চলেছে। এরাই কানাডার টরোন্টোতে বেগম পাড়া বানাচ্ছে, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কিনছে, ছেলেমেয়েদেরকে বিদেশে অভিবাসী করার জন্যে পাগল হয়ে গেছে। এভাবে যদি দুর্নীতি, পুঁজি লুন্ঠন ও পুঁজি পাচার না হতো তাহলে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের জিএনআই প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতো।
করোনাভাইরাস মহামারি অর্থনীতিকে বর্তমানে একটা বিপর্যয়ের গিরিখাদে নিক্ষেপ করেছে, যেখান থেকে মুক্তি পেতে জাতিকে আগামী এক-দেড় বছর কঠোর সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রামেও আমরা ইনশাআল্লাহ পাকিস্তান ও ভারতের চাইতে ভালো করছি। করোনা ভাইরাস মহামারিতে ভারতীয় অর্থনীতি বাংলাদেশের চাইতে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ-বছর বাংলাদেশের নমিনাল মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চাইতে কিছুটা বেশি হলেও স্বীকার করতেই হবে, সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত বাংলাদেশের চাইতে এগিয়ে রয়েছে। কঠিন সত্যটা হলো, ভারতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ছাড়িয়ে যেতে চাইলে জাতিকে অবিলম্বে দুর্নীতি, পুঁজি লুন্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করতেই হবে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়