অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাংলাদেশকেও মহাবিপদে ফেলবে
বাংলাদেশে গত এক দশকে অনেকগুলো মেগা-প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্প-প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় আখ্যা দেওয়া চলে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর এবং পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কঙবাজার ও ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের নিকৃষ্ট উদাহরণ। রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ সহ মোট এক লক্ষ তের হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে বলা হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, রাশিয়া ভারতে প্রায় একই ক্যাপাসিটির পরমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে দিয়েছে রূপপুরের অর্ধেক ব্যয়ে। অতএব, প্রশ্ন করা যৌক্তিক যে বাংলাদেশ কেন এত বেশি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে রাশিয়ার সাথে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে? আমাদের বর্তমান সরকার যে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার ধার ধারে না তার সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ এই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প। ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে রয়েছে যেখানে রূপপুর প্রকল্পের অর্ধেক ব্যয়ে ঐ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তাহলে এত ব্যয়বহুল ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প আমরা কেন গ্রহণ করলাম? এটা কার খামখেয়ালিপনার ফসল? এই ঋণ পরিশোধে ২০ বছর সময় লাগবে বলে সরকারীভাবেই জানানো হচ্ছে, কিন্তু প্রতি কিস্তিতে বাংলাদেশকে সুদাসলে কত পরিশোধ করতে হবে তা জনগণকে জানানো হোক্।
একইসাথে, যে দুটো রেলপথ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হলো সেগুলো অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। ওয়াকিবহাল মহল সহজেই বুঝবেন যে পদ্মা সেতুর সড়কপথ চালু হওয়ার পর ঐ সেতুর মাধ্যমে ঢাকা-যশোর-পায়রা পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথের অর্থনৈতিক ‘ফিজিবিলিটি’ ভবিষ্যতে খুব বেশি আকর্ষণীয় হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না, কারণ রেলপথটি মালামাল পরিবহনের তুলনামূলক খরচের বিবেচনায় সড়কপথের সাথে কখনোই প্রতিযোগিতামূলক বিবেচিত হবে না। ফলে, ভবিষ্যতেও এই রেলপথটি ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ থেকে যাবে। অতএব, ঐ প্রকল্পের সম্ভাব্য আয় দিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা চৈনিক ঋণের অর্থে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করা অসম্ভব প্রমাণিত হবে। এমনকি, ভারতকে এই রেলপথ ব্যবহার করতে দিলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রকল্পটি ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পই থেকে যাবে। একই আশংকা সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্প নিয়ে। ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মসূচির অধীনস্থ ‘বিসিআইএম ইকনমিক করিডোর’ যখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তোড়জোর চালু ছিল তখন বাংলাদেশকে মিয়ানমার হয়ে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং এর সাথে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু, ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ‘বিসিআইএম ইকনমিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠার চুক্তি থেকে সরে গেছে। অতএব, এই রেলপথটিও অদূর ভবিষ্যতে ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই রেলপথের আয় দিয়ে কখনোই এই প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে না। (তবে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণে যেহেতু এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে তাই ভবিষ্যতে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ রূপপুর প্রকল্পের চাইতে ‘কম অসহনীয় বোঝা’ হওয়ার কথা)! এই তিনটি প্রকল্পই ‘ইকনমিক ফিজিবিলিটি’ এর দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না। শ্রীলংকার ঋণের ফাঁদ সম্পর্কে আলোচনার সময় সেজন্যই এই তিনটি প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে ঋণের বোঝা সৃষ্টি করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করছেন।
দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে অত্যন্ত ব্যয়বহুল গ্ল্যামারাস প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোজগত দখল করেছে। উদাহরণ হিসেবে নিচে উল্লিখিত প্রকল্প-প্রস্তাবগুলোর নাম এসে যাবে: ১) ঢাকা-চট্টগ্রাম-কঙবাজার বুলেট ট্রেন, ২) দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ৩) পূর্বাচলে একশ’ দশ তলা-বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেক্স, ৪) শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৫) পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, ৬) নোয়াখালী বিমানবন্দর ৭) দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প এবং ৮) ঢাকার বাইরে রাজধানী স্থানান্তর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি’র ছাত্র হিসেবে প্রকল্প-মূল্যায়ন সম্পর্কে যেহেতু আমার উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয়েছে তাই এই প্রকল্পগুলোকে আমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করছি না। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, এসব প্রকল্প-প্রস্তাবের বাস্তবায়ন যে পর্যায়েই থাকুক সেগুলোর বাস্তবায়ন স্থগিত করা হোক্। প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি এসব চটকদার ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গৃহীত হয় তাহলে শ্রীলংকার মত ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশেরও দেরি হবে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের এপ্রিলে ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। ২০২০-২১ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ জিডিপি’র ৪২.৫ শতাংশ ছিল, কিন্তু এর মধ্যে জিডিপি’র ১৭.৫ শতাংশ ছিল ৬২.৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। চলমান মেগা-প্রজেক্টগুলোর ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় গত নয়-দশ মাসে বৈদেশিক ঋণ ৭২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। (কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ প্রকৃতপক্ষে ৯১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। সরকার নাকি এ-ব্যাপারে জনগণকে সঠিক খবর জানাচ্ছে না)।
২০২১-২২ অর্থ-বছরের নয় মাসে বাংলাদেশের আমদানি বিল গত বছরের চাইতে ৪৬ শতাংশ বেড়ে গেছে, যেটাকে আসন্ন মহাবিপদের ‘অশনি সংকেত’ আখ্যায়িত করাই সমীচীন। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই গতিতে আমদানি এল/সি খোলা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের ৩০ জুন তারিখে ২০২১-২২ অর্থ-বছরের মোট আমদানি ৮২-৮৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এর মানে, এই অর্থ-বছরের রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রাক্কলন সত্ত্বেও অর্থ-বছরের শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান অর্থ-বছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাবে। অতএব, এটা দেশের জন্য একটা মহাবিপদ ডেকে আনছে। কারণ, আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে এ-বছর প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে এত বড় ঘাটতি স্বাধীন বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। বরং, গত দুই দশক ধরে (গুটি কয়েক বছর ব্যতিরেকে) দেশের লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে উদ্বৃত্ত থাকাটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ২০০১ সালে মাত্র ১.০৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল সেখান থেকে গত দুই দশকে তা ক্রমাগতভাবে বেড়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। এবারের আমদানির বেলাগাম বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত সাত মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৪২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, এখন খানিকটা বেড়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। আগামী তিন মাসে রিজার্ভ আবারো কমে যাবে–এটা নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছে আমদানির অনিয়ন্ত্রিত উর্ধগতির কারণে। সেজন্যই আমার আকুল আহ্বান, সময় থাকতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমদানিতে ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজিপাচার বেলাগাম গতিতে বেড়ে চলার কারণেই এত দ্রুত আমদানি বিল বাড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ব্যাপারটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সামাল না দিলে অর্থনীতি গুরুতর বিপদে পড়বে।
করোনা ভাইরাস মহামারির তান্ডব কমতে না কমতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং আগ্রাসনের মোকাবিলায় পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় ইউক্রেনের মরণপণ প্রতিরোধ সারা বিশ্বকে এক ভয়াবহ যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। তেল, এলএনজি, রড, সিমেন্ট, ভোজ্যতেল, গম, ভুট্টাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে আগুন লেগে গেছে, জাহাজভাড়া বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের আমদানিতে, দেশের আমদানি ব্যয় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে এটাও বড় কারণ। করোনা ভাইরাস মহামারি অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আসায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চার হওয়ায় মূলধনী দ্রব্য আমদানিতেও বেশ কিছুটা গতি সঞ্চারিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু, আমদানি এল/সি বেলাগাম গতিতে বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজিপাচার আবারো পুরোদমে শুরু হওয়া। করোনা ভাইরাস মহামারির সময়ে হুন্ডি পদ্ধতি বেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল চাহিদা এবং সরবরাহ দু’দিক থেকেই। এর সুফল বাংলাদেশ পেয়েছে মহামারির দু’বছরে ফর্মাল চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণের জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে। আমাদের রফতানি আয়ে করোনা ভাইরাস মহামারি কিছুটা ধস নামালেও আমদানির শ্লথগতি এবং রেমিট্যান্সের জোয়ার দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে ঘাটতি সৃষ্টি হতে দেয়নি। বরং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল এই দু’বছর ধরে, যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। (শ্রীলংকায় মহামারির আগেও হুন্ডি সিস্টেম তেমন একটা জোরদার ভূমিকায় পৌঁছাতে না পারায় করোনা ভাইরাস মহামারির দু’বছরে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স ওখানে প্রায় আশি শতাংশ সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। একইসাথে, শ্রীলংকার রফতানি আয় অনেকখানি কমে গেছে এবং পর্যটন খাতের আয়ও প্রায় শতভাগ কমে গেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালু করতে গিয়ে কৃষি খাতে এক-তৃতীয়াংশ ফলন বিপর্যয় এবং করহার হ্রাসের হঠকারী সিদ্ধান্ত। এসব বিপর্যয়ের সম্মিলিত ধাক্কায় শ্রীলংকার অর্থনীতি এখন মহাসংকটে পতিত হয়েছে)।
বাংলাদেশের বর্তমান বেলাগাম আমদানির প্রবৃদ্ধি যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে আগামী মাসগুলোতে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ধসের প্রবণতা গেড়ে বসবে। এহেন ধস নামলে তিন/চার বছরের মধ্যেই ৪৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যেতে পারে। সেজন্য সময় থাকতেই এ-ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে সাবধান করে দিতে চাই। অবিলম্বে অর্থ-বছরের বাকি সময়ের আমদানির লাগাম কঠোরভাবে না টানলে ৩০ জুন ২০২২ তারিখে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টের ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সামাল দেওয়া যাবে না। (নেপাল ইতোমধ্যেই আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছে)। বাংলাদেশ ব্যাংক ১১ এপ্রিল তারিখে বিলাসদ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার আদেশ জারি করেছে। কিন্তু, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসআরও জারি করে ১৫০০ সিসি’র অতিরিক্ত ইঞ্জিন ক্ষমতার গাড়ী, বড় ফ্রিজ, এসি, বড় স্ক্রীনের টেলিভিশনসহ মহার্ঘ ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস, বিদেশী সেনিটারি ফিটিংস, বিদেশী বেকারী প্রোডাক্টস, এনার্জি ড্রিংকস, কোমল পানীয়, বিদেশী মহার্ঘ ফল ইত্যাদির আমদানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক্। একইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি এল/সি’তে ওভার-ইনভয়েসিং হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য জরুরী ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী সেল গঠন করতে পারে, যেখান থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ ব্যতিরেকে কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক এল/সি গুলো চূড়ান্তভাবে অর্থায়ন করতে পারবে না। ঐ প্রস্তাবিত সেল অতীতের বিভিন্ন বছরের আমদানির পরিমাণ, মূল্য এবং পণ্যের আন্তর্জাতিক দামের সাথে ইনভয়েসে উল্লিখিত দামের অসঙ্গতি চিịিত করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেবে। আগামী অর্থ-বছরের আমদানি নীতিতেও এহেন কঠোর নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখতেই হবে। নয়তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ধস আগামী বছরেও থামানো যাবে না।
২০২১-২২ অর্থ-বছরের বাজেটে ঋণের সুদাসল পরিশোধ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৮,৫৮৮ কোটি টাকা। মেগা-প্রজেক্টগুলোর ঋণ শোধের ‘গ্রেস-পিরিয়ড’ শেষ হলে আগামী অর্থ-বছরগুলোতে এই খাতে বরাদ্দ আরো অনেক দ্রুতগতিতে বাড়বে। সরকারের কর-জিডিপি’র অনুপাত যেখানে ৯ শতাংশের নিচে নেমে গেছে সেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য দ্রুতবর্ধমান বাজেট-বরাদ্দ অশনি সংকেতের শামিল। একইসাথে খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পোশাক রফতানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। বর্তমান অর্থ-বছরের রফতানি খাতের ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও তা আমদানির ৪৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে পারছে না। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে গেছে। এই প্রবণতাগুলো গেড়ে বসলে আমাদের অর্থনীতি মহাসংকটে পড়বে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়