আমার শিক্ষক, শিক্ষাগুরু ও পথ–প্রদর্শক প্রফেসর আনিসুর রহমান গত ৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন)। ১৯৭২ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র তখন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য প্রফেসর আনিসুর রহমান তাঁর কমিশনের কর্মপরিধি কিছুটা কমিয়ে আমাদের ‘মাইক্রো–ইকনমিঙ’ কোর্সটি পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। (যদিও ১৯৭১ সালে আমার এম এ পাশ করার কথা ছিল, কিন্তু ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে আমরা প্রায় দেড় বছর সেশন–বিলম্বের শিকার হয়েছিলাম)। ওটা ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে সেরা অর্জন, সেশন–বিলম্ব না হলে আমি আমার শিক্ষাজীবনের সেরা শিক্ষক প্রফেসর আনিসুর রহমানের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতাম, কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সেই ১৯৭২ সাল থেকেই ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রফেসর আনিসুর রহমান ছিলেন আমার ‘ফিলসফার–গাইড’ ও সার্বক্ষণিক শিক্ষাগুরু, সারা জীবন আমি তাঁকেই অনুসরণ করার সর্বাত্মক প্রয়াস অক্ষুণ্ন রেখেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রফেসর আনিসুর রহমান একাডেমিক্যালি ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট, কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন একজন ‘অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি–দার্শনিক’, যাঁর তুলনীয় ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বক্ষ্যমাণ কলামে আমি প্রফেসর আনিসুর রহমানের দর্শনকেই ফোকাস্ করতে চাই।
প্রফেসর আনিসুর রহমান কখনোই ‘দরিদ্র’ এবং ‘দারিদ্র্য নিরসন’ কথা দুটো ব্যবহার করতেন না। সমাজের প্রান্তিক অবস্থানের জনগণকে তিনি সুবিধা–বঞ্চিত জনগোষ্ঠী (ডিসএডভান্টেজড পিপল) আখ্যায়িত করতেন। কারণ, তাঁর দার্শনিক অবস্থান ছিল একটি দেশে বিদ্যমান ‘সমাজ–অর্থনীতি–রাজনীতির সিস্টেম’ সার্বক্ষণিকভাবে দারিদ্র্য সৃষ্টি এবং পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। এই ‘সিস্টেমকে’ পরিবর্তন করাকে মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে মোকাবেলা না করলে শুধু ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ কিংবা ‘মাইক্রো–ক্রেডিট’ দিয়ে কখনোই টেকসইভাবে দারিদ্র্যকে মোকাবেলা করা যাবে না। ২০০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধ ‘চড়াবৎঃু, ঙাবৎপড়সরহম চড়াবৎঃু ধহফ ঝবষভ–জবধষরুধঃরড়হ্থ–এ প্রদত্ত তাঁর একটি স্মরণীয় উক্তির বাংলা অনুবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে এ–সম্পর্কে তাঁর অবস্থানটি তুলে ধরছি,”যতদিন এভাবে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে ততদিন দারিদ্র্য–কবলিত গোষ্ঠীর আয়কে ধাপে ধাপে বাড়ানোর মাধ্যমে দারিদ্র্য কমানোর প্রয়াসগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে হয়ে দাঁড়াবে একটি নিচের দিকে চলমান এসকেলেটর ব্যবহার করে উপরে ওঠার মত কঠিন কাজ। এ রকম প্রয়াস সিস্টেম থেকে কখনোই দারিদ্র্যকে নির্মূল করতে পারবে না যদি ঐ এসকেলেটরের নিম্নগামী পতনকে (ডাউনওয়ার্ড গ্লাইড) সুইস অফ্ করে বন্ধ না করা হয়। এই সুইস অফ্ করার ব্যাপারটি হলো সমাজের কাঠামোগত রূপান্তরের মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সম্পদ ও সামাজিক ক্ষমতার পুনর্বন্টনের লক্ষ্য অর্জন”। মানুষকে মাইক্রো–ক্রেডিট কিংবা এনজিও ঋণ–সহায়তার ‘টার্গেট’ হিসেবে বিবেচনা করে দারিদ্র্য নিরসন করতে চাইলে সেটা মনুষ্যত্বকে অপমান করার শামিল হবে। আনিসুর রহমান মনে করতেন, বিশ্ব ব্যাংক অনুসৃত মাথাপিছু জিডিপির মাধ্যমে কিংবা দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের পরিমাপক দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপ করার মানে হলো মানুষকে গরু–ছাগলের পর্যায়ে নামিয়ে আনা। তিনি ‘দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর অনুপাতকে’ বলতেন ‘লাইভস্টক কনসেপ্ট অব পোভার্টি’। এ–ধরনের কনসেপ্টগুলো যে বাংলাদেশের জনগণকে অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার সাথে লুন্ঠনের ব্যাপারটিকে শাসকমহল কর্তৃক লুকিয়ে ফেলার জন্য অপব্যবহার করা হয়েছে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের পর সে ব্যাপারটি এখন দিবালোকের মত স্পষ্টভাবে উদঘাটিত হয়ে চলেছে। গত সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয়ভাবে বাড়ছে মর্মে ‘ডাটা ডক্টরিং’ এর মাধ্যমে ম্যানুফেকচারড্ (ভুয়া) পরিসংখ্যান প্রতি বছর সৃষ্টি করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছেন। প্রফেসর আনিসুর রহমানের দর্শনের ওপর ভিত্তি করে আমার রচিত ও ২০০৯ সালে রিসার্চ ইনিসিয়েটিভস, বাংলাদেশ (রিইব) কর্তৃক প্রকাশিত দ্য পোভার্টি ডিসকোর্স এন্ড পার্টিসিপেটরি একশান রিসার্চ ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থের মূল বক্তব্যটি এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধারণ করে রয়েছে। আনিসুর রহমান যখন আফ্রিকার তানজানিয়ায় তাঁর গণগবেষণার মাঠ পর্যায়ের প্রয়োগ চালাচ্ছিলেন তখন একজন কৃষক বলেছিলেন,‘আমাদেরকে ‘পুওর’ না বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ’।
প্রফেসর অমর্ত্য সেন এবং ডঃ মাহবুবুল হকের মানব উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি মাথাপিছু জিডিপি’র সংকীর্ণ কনসেপ্ট থেকে দারিদ্র্য ডিসকোর্সকে কিছুটা মুক্ত করলেও আরো অনেক কিছু বিবেচনা থেকে এখনো বাদ রয়ে গেছে। উন্নয়নে অমর্ত্য সেনের ‘এনটাইটেলমেন্ট’ ও ‘কেপেবিলিটি’ ধারণাগুলোকে আনিসুর রহমান সমর্থনযোগ্য মনে করলেও তিনি ওখানে থামতে নারাজ। তিনি উন্নয়নকে বিবেচনা করেন ‘মানুষের সৃজনশীল শক্তির স্বাধীনতা অর্জন’ (লিবারেশন অব পিপল’স ক্রিয়েটিভ এনার্জি), যেখানে আত্মবিকাশের অদম্য ইচ্ছা (আর্জ ফর সেল্ফ–রিয়ালাইজেশন) প্রধান নিয়ামকের ভুমিকা পালন করে। শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করে এহেন ইচ্ছাপূরণ সম্ভব না–ও হতে পারে। সমাজে বিদ্যমান বহু ধরনের বঞ্চনা ও গ্লানি নিরসন এহেন আত্মবিকাশের অংশ হতে পারে। মানুষের বঞ্চনার মাত্রায় সব সময় অর্থনৈতিক বঞ্চনাই যে শীর্ষস্থানে থাকবে সেটা না–ও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে একজন হরিজনের অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের চাইতে সামাজিক সম–মর্যাদা অর্জনের লড়াইয়ের অগ্রাধিকারকে উল্লেখ করা যায়। অথবা, একটি ইউরোপীয় উপনিবেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যটি জনগণের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়াই স্বাভাবিক। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে রাষ্ট্র ও বাজারের তুলনামূলক ভূমিকার চয়নের পাশাপাশি কম্যুনিটি ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠীগত প্রয়াসকেও আনিসুর রহমান সমভাবে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। সারা বিশ্বে ‘পার্টিসিপেটরি একশান রিসার্চের’ তিনজন আগুয়ান চিন্তানায়কদের (পায়োনিয়ার) মধ্যে আনিসুর রহমান ছিলেন একজন—বাকি দুজন ছিলেন বৃটেনের পিটার চ্যাম্বার্স এবং কলম্বিয়ার অরল্যান্ডো ফল্স–বোর্দা। আনিসুর রহমান পার্টিসিপেটরি একশান রিসার্চের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ‘গণগবেষণা’—যার মূল কথা হলো সমাজের সুবিধা–বঞ্চিত জনগোষ্ঠী নিজেরাই নিজেদের গণগবেষণার মাধ্যমে তাঁদের বঞ্চনা ও সুবিধাহীনতার কারণ বের করতে হবে। সরকার কিংবা কোন এনজিও’র প্রতিনিধি তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে এই বঞ্চনার কারণ উদঘাটন করে দেবে না। বাইরের কেউ ভূমিকা রাখতে চাইলে সাময়িকভাবে শুধু ‘উদ্দীপক’ (এনিমেটর) কিংবা ‘অসুবিধা–লাঘবকারী’র (ফেসিলিটেটর) ভূমিকায় থাকতে পারে। সেজন্য তিনি পাড়ার সকলকে মাসে অন্ততঃ দু’বার উঠান–বৈঠকে মিলিত হয়ে গণগবেষণার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যার কারণ বের করা এবং সম্ভাব্য সমাধান ঠিক করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। পরবর্তী বৈঠকে প্রস্তাবিত পদক্ষেপের সাফল্য–ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে নতুন পথ নির্ধারণের কথা বলেছেন তিনি । এভাবে সুবিধা–বঞ্চিত জনগণ নিজেরাই নিজেদের ‘কর্তা’ হয়ে বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে, তারা বাইরের কোন এনজিও কিংবা সরকারের খয়রাতি সাহায্যের মুখাপেক্ষী ‘টার্গেট পপুলেশন’ হবে না। গণগবেষণাকে আনিসুর রহমান ‘পিপল’স প্র্যাক্সিস’ অভিহিত করে বলেছেন, গণগবেষণা বঞ্চিত জনগণের মস্তিষ্কের মরিচা অপসারণের হাতিয়ার। এই গণগবেষণার দর্শনকে মাঠ–পর্যায়ে অনুশীলনের জন্যই তাঁর অনুগামীরা ‘রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস, বাংলাদেশ’ গড়ে তুলেছেন, যা দু’দশকের বেশি সময় ধরে দেশে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমি যখন ব্যাংকের খেলাপিঋণের ওপর আমার গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশে নানাবিধ কায়েমী স্বার্থের কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম তখন প্রফেসর আনিসুর রহমান আমাকে নিজস্ব–ব্যয়ে বইটি প্রকাশে উৎসাহিত করেছিলেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত আমার গ্রন্থ এ প্রোফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন বাংলাদেশ এর মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন তিনি। এই গ্রন্থের ৩১টি কেস স্টাডিকে তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘হেয়ার রেইজিং স্টরিজ’।
প্রফেসর আনিসুর রহমান তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর গত কয়েক বছর ধরে নিজেকে অনেকখানি গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু, ১৯৭২–৭৩ পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সবচেয়ে প্রগতিশীল সদস্য হিসেবে সবার চাইতে বেশি সমীহ আদায় করেছিলেন আনিসুর রহমান। ছাত্র–ছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন সবচেয়ে আদর্শ শিক্ষক। ষাটের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী তাত্ত্বিক হিসেবেও ছাত্র–ছাত্রী ও ওয়াকিবহাল মহলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের ‘টু ইকনমি থিসিসের’ অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় জনাব তাজউদ্দিন যখন ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দিল্লীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ও প্রবাসী সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা চালিয়েছিলেন তখন আনিসুর রহমান এবং রেহমান সোবহান ছিলেন জনাব তাজউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা ও সহ–আলোচক। ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশন বাংলাদেশের যে ‘ভূমি সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন’ করেছিল ঐ প্রস্তাবের রচয়িতা ছিলেন আনিসুর রহমান। যখন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর কাছে বিবেচনার জন্য ঐ প্রস্তাবমালা পেশ করেছিলেন তখন শেখ মনি ও তোফায়েল আহমদের মত পুঁজিবাদ–ভক্তদের সমালোচনার কারণে ঐ প্রস্তাবগুলো গ্রহণযোগ্য মনে করেননি বঙ্গবন্ধু। ১৯৯৩ সালে আনিস স্যার আমাকে ঐ প্রস্তাবসমূহের সাইক্লোস্টাইল কপিটি দিয়ে ভূমি সংস্কার বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। একটি দুর্ঘটনার কারণে আমি বিষয়টি যথেষ্ট গভীরভাবে গবেষণা করতে পারিনি, কিন্তু আমার প্রবন্ধে প্রস্তাবগুলো হুবহু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরা একটি অর্থবহ ভূমি সংস্কার আইন যে এখনো পাশ করতে পারলাম না, সে ব্যর্থতার কাহিনীটা এখানেই পাওয়া যাবে। জনাব তাজউদ্দিন নাকি হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাখ্যানের পর। মূলতঃ ঐ প্রত্যাখ্যানের কারণেই প্রফেসর আনিসুর রহমান পরিকল্পনা কমিশনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আরো দুঃখজনক হলো, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রফেসর আনিসুর রহমানকে কী অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। শুভাকাঙ্ক্ষীরা যথাসময়ে খবরটি তাঁকে জানানোয় তিনি তড়িঘড়ি করে দেশত্যাগ করেছিলেন। আইএলও তে চাকুরি করার সময় প্রফেসর আনিসুর রহমান তাঁর ‘পার্টিসিপেটরি একশান রিসার্চ’ এবং ‘সেল্ফ ডেভেলাপমেন্টের’ ধারণাগুলোকে বিশ্বের অনেক দেশে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘সেল্ফ ডেভেলাপমেন্ট’ বইটি দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়ে চলেছে। তাঁর প্রকাশিত যে আগুন জ্বলেছিল বইটি পড়লে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে অভূতপূর্ব ও প্রশংসনীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছিল সেগুলোর বর্ণনা পাঠককে অভিভূত করে দেয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঐ উদ্যোগগুলোকে পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। আইএলও এর চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বইটি লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে যখন প্রফেসর আনিসুর রহমান বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতির পদ গ্রহণ করেছিলেন তখন আমি তাঁর সাথে সমিতির সহ–সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ঐ সময় ড. মনমোহন সিং ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। আমরা আমন্ত্রিত হয়ে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় অর্থনীতি সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম। সম্মেলনে প্রফেসর আনিসুর রহমান বক্তব্য রাখার পর ড. মনমোহন সিং যেভাবে তাঁর প্রশংসা করেছিলেন সেটা এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের কাছে কতখানি সম্মানের পাত্র ছিলেন আনিসুর রহমান সেটাই ফুটে উঠেছিল ঐদিন। আমি প্রফেসর আনিসুর রহমানের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়