ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২৪ at ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

হাসিনার মাধ্যমে লুটে নেয়া বাংলাদেশকে উদ্ধারের প্রাণপণ প্রয়াস চালাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

সাড়ে পনেরো বছর ধরে গেড়ে বসা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রাণভয়ে বোন রেহানাকে সাথে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সামরিক বাহিনীসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিনচতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় অর্জন করে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐ ভূমিধস বিজয় হাসিনাকে হয়তো আজীবন প্রধানমন্ত্রীর মসনদ দখল করে রাখার সর্বনাশা খায়েসে মত্ত হয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ড থেকে কোন শিক্ষা হয়নি তাঁর। ২০১০ সালে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের সুবিধা নিয়ে ২০১১ সালে হাসিনা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের ব্যবস্থা করেছিলেন, যার ফলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সাড়ে দশ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা জবরদখলে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। ২০১১ সাল থেকেই সকল প্রধান বিরোধীদল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য আন্দোলনসংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হাসিনার তিনটি একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। বরং, ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে গত সাড়ে দশ বছর দেশের জনগণের মনে ধারণা গেড়ে বসেছিল যে হাসিনার জীবদ্দশায় এদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে আর সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। বিশেষত, একতরফা নির্বাচনী প্রহসন সত্ত্বেও প্রতিবেশী ভারত নিজের স্বার্থে হাসিনার সরকারকে বারবার মেনে নেয়ার কারণে জনগণের হতাশা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু, হাসিনা নিজের অবৈধ ক্ষমতাকে এসব নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী করায় ক্রমেই জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ক্রমবর্ধমান ক্রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে চলেছিল যে সুযোগ পেলেই তারা একটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে হাসিনার সরকারকে উৎখাত করে ছাড়বে। সে সুযোগ এনে দিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্রছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনসংগ্রাম। এই তিনটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ বরবাদ করে দিয়ে শেখ হাসিনাই গণঅভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন।

সরকারী চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যসদস্যাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটাসহ বিভিন্ন ক্যাটেগরির জন্য ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন সরকারউৎখাতের এক দফা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছিল ১৭ জুলাই তারিখে। তার কয়েকদিন আগে ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবিগুলোকে মেনে নেয়ার পরিবর্তে হাসিনা ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছিলেন ‘মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য কোটা রাখবে না তো কি রাজাকারদের নাতিপুতিদের জন্য কোটা রাখা হবে?’ এহেন অবিমৃষ্যকারী ও বালখিল্য কটূক্তির পরপরই ছাত্রছাত্রীরা স্লোগান দিতে শুরু করেছিল,‘আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার, দেশ বিকানো স্বৈরাচার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ এবং ‘চাইলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার’। মেধার ভিত্তিতে সরকারী চাকুরি পাওয়ার অধিকার সব ছাত্রছাত্রীর ন্যায্য সাংবিধানিক অধিকার, যে অধিকার ২০১৮ সালে হাসিনার সরকার স্বীকার করে নিয়েছিল। ২০২৪ সালের জুনের হাইকোর্টের রায়ে সে অধিকার হারাতে বসেছিল তারা। তাই, আন্দোলনে তাদের চাওয়া ছিল ন্যায্য। সেটা চাইতে গিয়ে তাদেরকে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ গালাগাল শুনতে হবে কেন? হাসিনার বালখিল্য মন্তব্যটি আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ল কোটাবিরোধী আন্দোলন। ঐ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদেরকে মারধর করে রাজপথ থেকে বিতাড়নের জন্য ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওদেরকে হটাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। তাঁর নির্দেশ পেয়ে লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু, এর বিপরীতে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগকে রুখে দাঁড়ায়। ফলে, দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ পড়তে শুরু করে। অন্যদিকে তুমুল গতিসঞ্চারিত হয় প্রতিরোধ সংগ্রামে, যার পরিণামে ছাত্রলীগ মার খেয়ে মাঠ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রলীগ। এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে বিএনপিজামায়াত ও ছাত্রদলশিবির কোটা বিরোধী আন্দোলনকে তাদের সরকার উৎখাতের এক দফার সহিংস ধ্বংসযজ্ঞে রূপান্তরিত করতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জ্বালাওপোড়াও, ঢাকার টেলিভিশন ভবন ভাঙচুর, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর রগকাটা, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা, দুটো মেট্রোরেল স্টেশন ধ্বংস, ইন্টারনেটের ডাটা সেন্টার ধ্বংস, সেতু মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অফিস ভাঙচুর, ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ট্রাক পোড়ানো, রেললাইন উপড়ানো, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, পুলিশকে আক্রমণ এবং সর্বোপরি ৪ আগস্টে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন ও নরসিংদীতে ৬ জন পুলিশকে পিটিয়ে হত্যাকোন কিছুই আর বাকি থাকে না। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ৪ আগস্ট তারিখে আবারও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মাস্তানদেরকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে লেলিয়ে দেন হাসিনা। আবারও একদিনে সারা দেশে নিহত হন এক’শ এর বেশি মানুষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট তারিখে ‘স্বৈরাচারী শাসকের পতনের উদ্দেশ্যে ‘মার্চ টু ঢাকা’ এর ডাক দেয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে লাখো জনতা ঢাকা পৌঁছে যায় ৫ আগস্টের মধ্যেই। ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় যখন পলায়নকারী শেখ হাসিনার উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে উড়াল দেয় তখন ঢাকার উপকন্ঠ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল রাজপথ ধরে শাহবাগ, গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে ধাবিত হয়। কমপক্ষে কুড়ি লাখের মত মানুষ ঢাকায় জড়ো হয়ে গণঅভ্যুত্থানটিকে সফল করে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি উদযাপন করে।

হাসিনা তাঁর সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে নিকৃষ্টতম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মাধ্যমে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্কব্যবসায়ী এবং পুঁজিলুটেরাদেরকে সাথে নিয়ে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তার ভয়াবহ কাহিনী তাঁর পতনের পর উদ্‌ঘাটিত হতে শুরু করেছে। ৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্যউপাত্তে দেখা যাচ্ছে সাড়ে পনেরো বছরে দেশের জনগণকে পনেরো লক্ষ আটান্ন হাজার দুই’শ ছয় কোটি টাকা ঋণের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা দেশ থেকে ভেগে গেছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র দুই লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার আট’শ ত্রিশ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অংকের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে উপরে উল্লিখিত পনেরো লক্ষ আটান্নো হাজার দুই’শ ছয় কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপি’র উচ্চপ্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে এক কথায় বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সাথে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রতিজন বাংলাদেশীর মাথার ওপর এক লক্ষ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে। শুধু একজন এস আলম নাকি ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংকের মালিকানা জবরদখলের মাধ্যমে প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। হাসিনার বেসরকারী বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা সালমান রহমান তার বেক্সিমকো গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লুটে নিয়েছে ছত্রিশ হাজার আট’শ পঁয়ষট্টি কোটি টাকা। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামের সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে জয় ও বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকীর সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের রাশিয়ান ঠিকাদার রোসাটম থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঘুষ খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রতিটি মেগাপ্রকল্প ও দেশের শত শত প্রকল্প থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে এই সাড়ে পনেরো বছরে। উপরন্তু, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে প্রচন্ড লুটপাটের শিকার করে রেখেছিল হাসিনার সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুরের প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট পৌনে সতেরো লক্ষ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের মধ্যে কমপক্ষে ছয় লক্ষ কোটি টাকা খেলাপিঋণে পরিণত হয়েছে, যার অধিকাংশই দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। রাঘববোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদেরকে’ ট্রাইব্যুনালের বিচারের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে হাসিনা সরকার ছিল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি দাবি করেছে যে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত তিন বছরে ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও হাসিনার টনক নড়েনি।

৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর গত সোয়া দুই মাস ধরে প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে ‘মেল্টডাউন’ থেকে বাঁচানোর জন্য। এস আলম কর্তৃক লুটে নেয়া সাতটি ব্যাংকসহ এগারটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে এসব ব্যাংককে দেউলিয়া হওয়া থেকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েকটি ব্যাংককে তারল্য সরবরাহ করা হয়েছে ওগুলোকে আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলারবিক্রয় বন্ধ করা হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পতনকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য। আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক, জাইকা ও এডিবি থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে রিজার্ভকে কিছুটা চাঙা করার জন্য। মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্দেশ্যে অনেকগুলো পণ্য আমদানিতে শুল্কহ্রাস করা হয়েছে। একইসাথে, ডলারের দামকে টাকার অংকে এক’শ কুড়ি টাকায় স্থিতিশীল রাখার প্রয়াস জোরদার করা হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা নিরসনের উদ্দেশ্যে। আমদানি বাণিজ্যের ওভারইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং কঠোর ও জোরদার করা হয়েছে। অবশ্য, খুশির খবর হলো যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর দু’মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে ডলারের সরবরাহ অনেকখানি বেড়ে যাওয়ায় কার্ব মার্কেটে ডলারের দামের পার্থক্য সরকারনির্ধারিত বাজারের দামের ১ শতাংশের মধ্যে এসে গেছে এবং স্থিতিশীল রয়েছে। উপরের তথ্যউপাত্ত থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে দেশের ফাইনেন্সিয়াল খাতের মারাত্মক সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি টিমকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর একটি শ্বেতপত্র রচনার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। ঐ প্রতিবেদন থেকে সরকার অর্থনীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক্‌নির্দেশনা পেয়ে যাবে। উপরন্তু, প্রফেসর ইউনূস দেশের ছয়জন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনগুলো তাঁদের প্রতিবেদন এবং সুপারিশপ্রণয়ন সম্পন্ন করবেন বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর ঐ সুপারিশগুলো নিয়ে সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চূড়ান্তভাবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করবে। ঐ প্রক্রিয়ার পর দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ঘোষণা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রফেসর ইউনূস। উপরের বর্ণনা থেকে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সুষ্পষ্ট দিক্‌নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকজন উপদেষ্টার কার্যক্রমে মন্থরতার অভিযোগ উত্থাপিত হলেও মোটামুটিভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্সে জনগণ খুশি।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসার অনুরণন ছাড়া
পরবর্তী নিবন্ধজলাতঙ্ক থেকে শিশুকে পরিত্রাণ দিতে হলে