ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৩ অক্টোবর, ২০২৪ at ৪:৫২ পূর্বাহ্ণ

হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশকে

লুটেপুটে কোটিপতি হয়ে পালিয়ে গেছে

পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে তাঁর সাম্রাজ্য বিবেচনা করে গত সাড়ে পনেরো বছরে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর হাসিনা ও রেহানা তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কৃপায় ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। ঐ সময় তাঁদেরকে দিল্লীতে অত্যন্ত সাধারণ মানের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে হয়েছিল। শেখ রেহানা বিয়ের পর বিলেতে চলে গেলেও ওখানে অত্যন্ত টানাপড়েনের মধ্যেই তাঁর পরিবারকে জীবন যাপন করতে হয়েছিল। ১৯৮১ সালের এপ্রিলে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসতে পারলেও ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পূর্বে লুটপাটের তেমন সুযোগ পাননি, যদিও আশির দশকে তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী সমরপ্রভু এরশাদের কাছ থেকে কয়েকবার আর্থিক উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। ঐ সময় হাসিনার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬২০০১ ক্ষমতার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রধান নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের জন্য দুর্নীতিকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষত, ঐ নির্বাচনের আগের কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের শাসনামলের দুর্নীতিকে হাইলাইট করে প্রচারিত ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর টেলিভিশন অনুষ্ঠানটি ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়কর পরাজয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু, ২০০১২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতাসীন বিএনপিজামায়াত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বেলাগাম দুর্নীতি, বিএনপি’র যুবরাজ তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের লুটপাট ও প্যারালেল সরকার পরিচালনা, জামায়াতের জঙ্গিলালন, বাংলা ভাইয়ের তান্ডব, জেএমবি’র সন্ত্রাস ও বোমাবাজি, ২০০৪ সালের দশট্রাক অস্ত্র উদ্ধার এবং সর্বোপরি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জন নেতাকর্মী হত্যা ও ২০০৫ সালের আগস্টে ৬৩ জেলায় বোমাবাজি ২০০৬ সালের শেষে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বিএনপিজামায়াতের পরাজয়কে অবধারিত করে তুলেছিল। এরপর, ২০০৬৭ সালের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপশাসন ও নির্লজ্জ বিএনপিতোষণ এবং সর্বশেষে ২০০৭ সালের ১/১১ এর সামরিক অভ্যুত্থানপরবর্তী ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ রাজনীতির পটপরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক হয়ে ওঠে।

এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিনচতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করতে সমর্থ হয়। ঐ ভূমিধস বিজয় হাসিনাকে হয়তো আজীবন প্রধানমন্ত্রীর মসনদ দখল করে রাখার সর্বনাশা খায়েসে মত্ত হয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড থেকে কোন শিক্ষা হয়নি তাঁর। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন হাসিনা। এই তিনটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ বরবাদ করে দিয়ে শেখ হাসিনাই গণঅভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন। গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাঁর একনায়কত্বকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি। ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে লাখ লাখ মানুষ যেভাবে সবদিক্‌ থেকে গণভবনের দিকে মিছিল নিয়ে ছুটে গিয়েছিল তা দমানোর শক্তি সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশ বাহিনীর থাকার প্রশ্নই আসে না। ঐদিন দুপুর বারটা পর্যন্ত শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা গ্রহণের অবস্থানে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেনাপ্রধান বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাঁর আদেশ মানেননি। হাজার হাজার জনতাকে হত্যা করলেও সেনাবাহিনী এই গণঅভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত হয়ে যেতো। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সশরীরে পালিয়ে যেতে পারলেও সর্বশেষ হিসেব মোতাবেক জুলাইআগস্টের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞে সাত’শ আটজন মানুষের প্রাণ গেছে। শেখ হাসিনা কোনমতেই এসব প্রাণহানির দায় এড়াতে পারবেন না।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই হাসিনা দেশটাকে তাঁর সাম্রাজ্য হিসেবে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করার মিশনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, সাথে ছিল তাঁর পরিবারের সদস্যগণ, তাঁর আত্মীয়স্বজনরা এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীধনকুবেররা। প্রধানত, উন্নয়নপ্রকল্পের নামে পুঁজি লুন্ঠনকে হাসিনা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। হাসিনা তাঁর সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মাধ্যমে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্কব্যবসায়ী এবং পুঁজিলুটেরাদেরকে সাথে নিয়ে সরকারী খাতের প্রকল্প থেকে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তার ভয়াবহ কাহিনী তাঁর পতনের পর উদ্‌ঘাটিত হতে শুরু করেছে। ৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্যউপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র দুই লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার আট’শ ত্রিশ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অংকের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে পনেরো লক্ষ আটান্নো হাজার দুই’শ ছয় কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপি’র উচ্চপ্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে এক কথায় বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সাথে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিজন বাংলাদেশীর মাথার ওপর এক লক্ষ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে।

হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগাপ্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগাপ্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিনচার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা, যে জন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশের এমন একটি প্রকল্পের নাম করা যাবে না যেটার খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ছাড়া কম নয়। হাসিনার সরকার বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যে মেগাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করেছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে তার তালিকাটা দেখুন: পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা বিআরটি প্রকল্প, ঢাকাআশুলিয়া উড়ালসড়ক, ঢাকাচট্টগ্রাম চার লেইনের মহাসড়ক, মিরসরাইফেনীতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকামাওয়াভাঙাপায়রাযশোর রেলপথ, যমুনা রেলসেতু, পতেঙ্গা নিউমুরিং টার্মিনাল, আখাউড়ালাকসাম ডবল লাইন রেলপথ এবং চট্টগ্রামদোহাজারীকক্সবাজার রেলপথ। এগুলো ছাড়াও সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত সাড়ে পনেরো বছরে শত শত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এতদ্‌সত্ত্বেও হাসিনা জনগণের বিশাল বৃহদংশের মন জয় করতে পারেননি, তাঁর সরকারকে উৎখাত করেছে গণঅভ্যুত্থান। কারণ, এই প্রকল্পগুলোকে জনগণ পুঁজিলুন্ঠনের মেগামওকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

আর, এই পুঁজিলুন্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনাপুত্র জয়, রেহানাকন্যা টিউলিপ ও রেহানাপুত্র ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল, তাঁর ভাই শেখ জুয়েল ও তাঁর পুত্র শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাঁর পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দু’হাতে টাকা বানাতে হবে’। প্রতিমন্ত্রীত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রকৃতপক্ষে সরকারের সবকিছু পরিচালনা করছিল হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা, মন্ত্রীপ্রতিমন্ত্রীরা শুধুই শিখন্ডী। চরমভাবে হতাশ হয়ে ২০০৯ সালের মে মাসেই সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সম্প্রতি একটি মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ‘গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প’ দাবি করেছে যে শেখ হাসিনা তাঁর পুত্র জয় এবং শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপের মধ্যস্থতায় এবং একটি মালয়েশিয়ান ব্যাংকের সহায়তায় রূপপুর প্রকল্প থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন। (অবশ্য, রাশিয়ান ঠিকাদারি সংস্থা রোসাটম এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে)। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়িত একটি প্রকল্পেরও নাম বলা যাবে না যেখান থেকে হাসিনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন কিংবা তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাধন্য অলিগার্কব্যবসায়ীরা মোটা দাগে অর্থআত্মসাৎ করেনি। অতি সম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছে, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে এক লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করেছে তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান রহমান নিজেও তার মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ছত্রিশ হাজার আট’শ পঁয়ষট্টি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি। সে জনতা ব্যাংক থেকে নিয়েছে তেইশ হাজার কোটি টাকা, আর আইএফআইসি ব্যাংক থেকে নিয়েছে এগার হাজার কোটি টাকা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছে, যেগুলোর প্রকল্পব্যয় একান্ন হাজার কোটি টাকার বেশি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ তাপস মধুমতি ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়েছে, আরেক আত্মীয় আকরামউদ্দিন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের লাইসেন্স বাগিয়েছে। আরেক আত্মীয় তাকসিম খান ঢাকা ওয়াসাকে লুটেপুটে খেয়েছে পনেরো বছর। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ার সুবাদে বেনজীর আহমদ পুলিশে রাজত্ব চালিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে যথাসময়ে বিদেশে ভেগে গেছে। শেখ রেহানার দেবর তারেক সিদ্দিকী সেনাবাহিনীতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছিল হাসিনার পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, সে কয়েক’শ কোটি টাকা লুট করেছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এই সাড়ে পনেরো বছরে দেশের পুলিশ বাহিনী ‘গোপালী অফিসারদের রাজত্ব’ থেকে একদিনও মুক্ত ছিল না। একইসাথে, পুলিশ বাহিনীর সব স্তরেই বেধড়ক দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছিলেন হাসিনা। সেজন্যই হাসিনার নির্দেশে পুলিশের গুলিতে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এই গণঅভ্যুত্থানে, কয়েক হাজার মানুষ অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে গেছে। দুঃখজনক হলো, হাসিনার একজন আত্মীয়ের নামও বলা যাবে না যিনি বা যাঁরা নিজগুণে সরকারের বড় কোন পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।

এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে হাসিনার পতনের পর গত দু’মাসে তাঁর একজন আত্মীয়ও পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি, সবাই যথাসময়ে দেশ থেকে ভেগে যেতে পেরেছে। শেখ তাপস তো হাসিনার পতনের আভাস পেয়ে ৩ আগস্ট তারিখেই দেশ থেকে ভেগে গেছে, রেহানাপুত্র ববিও ভেগেছিল। পতনের আগেপরে অন্যরাও গোপনে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের সবাই কোটিপতি হয়ে গেছে, সবারই বিদেশে হয়তো বাড়িঘর রয়েছে কিংবা নাগরিকত্ব রয়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, হাসিনার শাসনামলে সবাই প্রস্তুতি সেরে রেখেছিল বিদেশে ভেগে যাওয়ার। ইতোমধ্যে দেশের যেখানেই তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপাতি ছিল সব হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নয়তো লুটতরাজ ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। এতদ্‌সত্ত্বেও গত সাড়ে পনেরো বছরে দেশ থেকে বিদেশে যে পরিমাণ অর্থ তারা পাচার করতে সক্ষম হয়েছে তা দিয়ে বাকি জীবনটা বিদেশে আরামআয়েশে কাটিয়ে দেবে তারা। আফসোস হচ্ছে, তারা যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে ভেগে যেতে পেরেছে সে অর্থ দেশের জনগণ কখনোই ফেরত পাবে না।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসার পাদটীকা
পরবর্তী নিবন্ধতরুণ প্রজন্মের পাঠ অভ্যাসের গুরুত্ব