দেশের চামড়া শিল্পে জড়িত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তবে ট্যানারি শিল্প মালিকদের সংগঠন দাবি করছে, বর্তমান বাস্তবতায় এই মজুরি পরিমাণ বেতন দেওয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, তারা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে এমন মজুরি করবেন, যা বাস্তবায়নযোগ্য হয়। খবর বিডিনিউজের।
এই শিল্পের মজুরিকাঠামো কত হতে পারে তার সুপারিশ করতে ‘প্রোপোজাল ফর মিনিমাম ওয়েজ ফর দ্য বাংলাদেশি ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রি ইন ২০২৪’ শীর্ষক একটি গবেষণাও হয়েছে। সিপিডির সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করে লেদার ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (এলডিএফ) এবং ওশি ফাউন্ডেশন নামে দুটি সংস্থা।
গতকাল রাজধানীতে ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে গবেষণা পরিচালনা কমিটির সদস্য তামিম আহমেদ বলেন, আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছি ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা।
সর্বপ্রথম দেশে ২০১১ সালে ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয় আট হাজার ৭৫০ টাকা। সবশেষ ২০১৮ সালে শহর অঞ্চলের শ্রমিকদের ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ও গ্রামীণ জনপদের জন্য ১২ হাজার ৮৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়। গবেষণায় উঠে আসে, ২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার ছয় বছর পরও ৬০ শতাংশ ট্যানারি শিল্প তা বাস্তবায়ন করেনি। ট্যানারি খাতের জন্য ন্যূনতম মজুরি পুনর্বিন্যাস করতে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে নতুন বোর্ড গঠন করে সরকার। এই বোর্ডের কাছে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে মালিকপক্ষ ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা বেতন নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে বলে জানিয়েছেন গোলাম মোয়াজ্জেম। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাবনায় সিপিডি বলছে, চার থেকে ছয় সদস্যের পরিবারের শ্রমিকদের খাদ্য ব্যয় ২০ হাজার ৫৬৪ ও খাদ্য বহির্ভূত ব্যয় ১২ হাজার ৮৮১ টাকা। সব মিলিয়ে মাসে গড়ে খরচ হয় ৩৩ হাজার ৪৪৫ টাকা।
খরচের চেয়ে ন্যূনতম মজুরি কম ধরার ব্যাখ্যায় তামিম আহমেদ বলেন, শ্রমিক পরিবার হওয়ায় অন্যান্য সদস্যের কিছু আয় আছে। আমরা দেখেছি, তাদের (শ্রমিকদের) ধার করার পরিমাণ কমেছে, যদিও তারা সঞ্চয় ভাঙছেন বা সঞ্চয় করছেন না। প্রতি পরিবারের হাঁস–মুরগি বা গরু পালন ও কৃষি খাত থেকে কিছু আয় আসে। এসব বিবেচনা নিয়েই ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব করছি।
অবশ্য বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো সমর্থন করেন না এই গবেষক। তিনি বলেন, বিশ্বের কোথাও শুধু ট্যানারি শিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি নেই। দেশগুলোতে খাতভিত্তিক কোনো শিল্পের স্বতন্ত্র ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নেই। সব খাতের শ্রমিকদের জন্য একই হারে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে দেওয়া আছে। অথচ বাংলাদেশে খাতভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য আলাদা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা আছে। বাংলাদেশে ট্যানারিতে ন্যূনতম মজুরি ১২৩ ডলার। তৈরি পোশাক খাতে এটি ১১৪ ডলার।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও গবেষণার নেতৃত্বে থাকা গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান মজুরি কাঠামোতে মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া, স্বাস্থ্য ও যাতায়াত এই চারটি খাত রয়েছে। আগামীতে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য শিক্ষা খাত যোগ করে বেতন কাঠামো ঠিক করার প্রস্তাবনা দিয়েছি।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, ট্যানারি শিল্পে শতাধিক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যা স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে দীর্ঘমেয়াদে। আঙুল কেটে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রমিকদের চিকিৎসার ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। আমরা দাবি করছি, শিল্প এলাকায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার।
বাংলাদেশ ট্যানার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, চামড়ার শতভাগ দেশ থেকেই পাওয়া যায়। তাই খাতটির উন্নয়নে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে যেন মজুরি নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, বতর্মান বাস্তবতায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব না। গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আমাদের পণ্য উৎপাদন খরচে বেড়েছে। রাসায়নিকের দাম বেড়েছে ডলার সংকটের কারণে। আমাদের রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও পণ্যের মূল্য কমে গেছে। আমরা চেষ্টা করব একটি গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণের, যাতে শ্রমিক ও ট্যানারি শিল্প উদ্যোক্তারা টিকে থাকতে পারেন।