টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা ও শোভন কাজ

ফজলুল কবির মিন্টু | মঙ্গলবার , ১৪ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত একটি উন্নয়নশীল দেশ। সর্বশেষ আদম শুমারি অনুযায়ী এদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ষোল কোটি। এটি পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল দেশ। বাংলাদেশের শ্রমিক সংখ্যাও সাড়ে ছয় কোটির অধিক। শ্রমিক সংখ্যার বিচারেও বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে ৭ম স্থান দখল করে রেখেছে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে এদেশে উল্লেখযোগ্য হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের সুফল যেন প্রান্তিক পর্যায়ে তথা শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছছে না। ফলে এত উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশ শোভন কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার ১৭টি গোলের ৮ম গোল হচ্ছে শোভন কাজ। যার একমাত্র লক্ষ হচ্ছে কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা এবং একই সাথে উক্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে যাতে দেশের মানুষ উপকৃত হয় সেদিকে লক্ষ রাখা। একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে, বিশ্বে এবং বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য শোভন কাজ বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি পোশাক শিল্প খাত। বৈদেশিক মুদ্রার ৮০% অর্জিত হয় এই খাত থেকে। যদিও পোশাক শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তথাপি এই শিল্পে শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। শ্রমিকদের মজুরি খুবই কম। যা বর্তমান উর্ধ্বগতির বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে শিল্পে কর্মরত শ্রমিকেরা তাদের পরিবারের অতি প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে গিয়ে প্রায়শঃ অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হয় কিংবা শ্রমিকদেরকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়। সাধারণত পোশাক শিল্পে শ্রমিকদেরকে নিয়মিত ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অর্থাৎ শ্রমিকদের দৈনিক ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। অতিরিক্ত কাজের জন্য সাধারণ শ্রমিকেরা ওভারটাইম ভাতা পেলেও লাইন লীডার, সুপারভাইজারদেরকে তদারকি কর্মকর্তা লেভেল লাগিয়ে দিয়ে ওভারটাইম ভাতা দেয়া হয় না। বেসরকারি স্বাস্থ্য সেক্টরে অধিকাংশ শ্রমিকেরা একই প্রতিষ্ঠানে দুই শিফটে কিংবা দুই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। এর ফলে আপাত দৃষ্টিতে কিছু বাড়তি মজুরি পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে তারা যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে একথা আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

দেশের পোশাক খাতসহ অন্যান্য বিভিন্ন শ্রমখাতের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একদিকে শ্রমিকেরা কম মজুরি পায় আবার অন্যদিকে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথেষ্ট অপ্রতুল। বাংলাদেশে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধস, সেজান জুস কারখানায় আগুন, বি এম ডিপো দুর্ঘটনা এবং সর্বশেষ সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের ফলে ব্যাপক শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশে শোভন কাজ বাস্তবায়নের রাষ্ট্রীয় ও মালিক পক্ষের উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে শ্রমিক সংগঠন সমূহ শোভন বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষকে কার্যকরভাবে চাপ সৃষ্টি করতে সফলতার পরিচয় দিতে পারছে না।

শোভান কাজ বাস্তবায়নে আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দেশে ব্যাপক হারে শিশু শ্রমের ব্যবহার। যদিও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এই সমস্যা সমাধানের জন্য দেশে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা আছে কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ব্যাপক সংখ্যক শিশু শ্রমিক এখনো ঝুকিপূর্ণ শিশু শ্রমের সাথে যুক্ত আছে এবং এতে কেবল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রমমান ভঙ্গ হচ্ছে তাই নয় বরং যেসকল শিশুরা এধরনের ঝুকিপূর্ণ শ্রমের সাথে যুক্ত তাদের জীবনও হুমকির মধ্যে থাকে। তাছাড়া শিশু বয়সে শ্রমে যুক্ত হওয়ার কারণে দেশের জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু বয়স থেকে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এবং শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। শিশু শ্রম হ্রাস এবং শিশুরা যাতে শিক্ষার অধিকারসহ তাদের মানসিক বিকাশের জন্য অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সমূহ পায় তারজন্য রাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন করতে হলে শোভন কাজ বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং শিশু শ্রম হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি শ্রমিকের নিরাপত্তা এবং জীবনধারণ উপযোগী মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম আইন বাস্তবায়নে মালিক পক্ষকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। শোভন কাজ বাস্তবায়নে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহেরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা শ্রমিকদের সংকট চিহ্নিত করে তা নিরসনে লবি, এডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন করে রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় এবং জোরালো উদ্যোগ নিতে পারে যাতে শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোভন কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন হয়।

জাতিসংঘ ২০১৬ সাল থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়কালকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের সময়কাল হিসাবে নির্ধারণ করেছে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকেও এই সময়কালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন করতে হবে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত সময়কালের অর্ধেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ শোভন কাজ বাস্তবায়নে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সুতরাং শোভন কাজ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের উদ্যোগ গ্রহণ করার এখনই যথার্থ সময় অন্যথায় আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে যাবো।

লেখক: সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাগরিত হোক নারী জীবন
পরবর্তী নিবন্ধনানা স্তরের দুর্নীতি ব্যবসার পরিবেশ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে