ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। গতকাল বুধবারের রেকর্ড বৃষ্টিপাতে মানুষের দুর্ভোগ আরো চরম আকার ধারণ করেছে। এদিকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা দিয়েছে বন্যার শঙ্কা। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসেরও শঙ্কা রয়েছে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। এছাড়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ধসে পড়েছে কয়েকটি বসতঘর, উপড়ে গেছে গাছ।
টেকনাফ : কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ৮টি গ্রাম, হ্নীলা ইউনিয়নে ১২টি গ্রাম, টেকনাফ পৌরসভার ৭টি গ্রাম, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৬টি গ্রাম, সাবরাং ইউনিয়নে ৭টি গ্রাম, বাহারছড়া ইউনিয়নে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লোকজন সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপজেলার সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে হ্নীলায়। বর্ষার শুরু থেকে এই ইউনিয়ন দফায় দফায় প্লাবিত হয়। হ্নীলা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, হ্নীলা ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের চার হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। এসব গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে জালিয়াপাড়া, সাইটপাড়া, ফুলের ডেইল, আলী আকবর পাড়া, রঙ্গিখালী লামার পাড়া, আলীখালী, চৌধুরী পাড়া, পূর্ব পানখালী, মৌলভীবাজার, লামার পাড়া, ওয়াব্রাং, সুলিশপাড়া ও পূর্ব সিকদার পাড়া। গ্রামগুলোর চলাচলের রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আবদুল্লাহ মনির জানান, টেকনাফ পৌরসভার কলেজপাড়া, শীলবুনিয়া পাড়া, ডেইলপাড়া, জালিয়াপাড়া, খানকারডেইল, চৌধুরীপাড়া, কেকে পাড়ার মানুষ এখন পানিবন্দি। পানিতে ডুবে আছে টেকনাফ কলেজসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। পৌরসভার ৭, ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু ঘরবাড়িসহ চলাচলের রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, টেকনাফ সদরের ৬ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এগুলো হল মহেশখালীয়া পাড়া, নতুন পাল্লান পাড়া, তুলাতুলী, লেঙ্গুরবিল, খোনকারপাড়া, মাঠপাড়া ও রাজারছড়া, জাহাঁলিয়া পাড়া। একই সঙ্গে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের ৭টি গ্রামসহ ১০ গ্রাম এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বা বিল, উলুবনিয়া, আমতলী, মিনাবাজার, উনচিপ্রাং, কাঞ্চনপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, রইক্ষ্যং গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন, টেকনাফে ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। এতে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশ এলাকা পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। পানিবন্দি লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় এবং তাদের সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চন্দনাইশ : চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানান, টানা ৩ দিনের বর্ষণে চন্দনাইশ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ সড়কে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢল নামায় শক্সখনদীর পানি বেড়ে বিপদ সীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদী তীরবর্তী দোহাজারী পৌরসভা, বৈলতলী, বরমা, বরকল, সাতবাড়িয়া, পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়ার ইউনিয়ন কালিয়াইশ, ধর্মপুর, বাজালিয়া, পুরানগড়, খাগরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ বন্যা আতংকে রয়েছেন। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় চন্দনাইশের কাঞ্চনাবাদ, হাশিমপুর, জামিজুরী ও ধোপাছড়িতে পাহাড় ধসেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়া ও সতর্কতা অবলম্বন করার লক্ষ্যে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে অবগত করেছেন।
সাতকানিয়ার পূর্ব কাটগড় গ্রামের বাসিন্দা আহমদ হোসেন জানান, উপজেলার প্রায় নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাটে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে নিত্য কাজ–কর্ম করতে ও চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে সাধারণ মানুষের। উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় বেশ কয়েকটি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানা যায়। শক্সখচরের কৃষক মোহাম্মদ মারুফ ও মো. হাসান জানান, গত তিনদিনের বৃষ্টিপাতে শক্সখনদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীতে প্রবাহিত পানি ইতোমধ্যে চরের নিচু অংশে রোপণকৃত অধিকাংশ সবজি ক্ষেতের কাছাকাছি চলে এসেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে নিচু অংশের সমস্ত সবজি ক্ষেত ডুবে যাবে। পাশাপাশি সমতলের অধিকাংশ সবজি ক্ষেতও পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে জানান তারা।
চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাজিব হোসেন জানান, অতিভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারীদের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে। অতি ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং ও প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
লোহাগাড়া : লোহাগাড়া প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় বামির খালে পানির স্রোতে ব্রিজের দুপাশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে যানবাহনসহ মানুষের যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে যেকোনো মুহুর্তে ধসে পড়তে পারে ব্রিজটি। উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের লোহার দিঘীর পাড়ের পূর্ব পাশে দফাদার পাড়ায় এ ভাঙন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও পানির ঢলে বামির খালের দফাদার পাড়া এলাকায় একটি ব্রিজের দুই পাশে ভাঙন দেখা দেয়। যার ফলে বর্তমানে ওই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এলাকাবাসীর চলাচলের রাস্তার ব্রিজ ভেঙে গেলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
গতকাল বুধবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, পানির স্রোতে ইতোমধ্যে ব্রিজের দুই পাশে অনেকাংশ মাটি সরে গেছে। বৃষ্টি ও পানির স্রোত অব্যাহত থাকলে যেকোনো মুহুর্তে ধসে যেতে পারে ব্রিজেটি। স্থানীয় আবু সাইদ জানান, এলাকার জন্য সড়কটি খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভেঙে যেতে পারে ব্রিজটি। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. হামিদ জানান, সম্প্রতি বামির খাল খননের সময় অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজের গোড়া থেকে মাটি কাটা হয়। যার ফলে টানা বৃষ্টি ও পানির স্রোতে ব্রিজের দুই পাশের মাটি সরে গেছে। এতে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে ব্রিজটি। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
রাঙ্গুনিয়া : রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জানান, তীব্র ঝড়ে উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টানা ভারী বৃষ্টি ও ধমকা বাতাসে রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে পড়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ধসে পড়েছে ৫টি বসতঘর এবং বিভিন্ন স্থানে সড়ক ধসের খবর পাওয়া গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে একাধিক জনগুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম এবং তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে নদী তীরবর্তী এলাকায়। এছাড়া পাহাড় ধসের ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়েছে উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায়।
জানা যায়, উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের চন্দ্রঘোনা–নিশ্চিন্তাপুর সেগুনবাগিচা সড়কের হাজী টিলা সংলগ্ন খামার বাড়ি হিজ্জেরতল গতকাল বুধবার দুপুরে কয়েকটি গাছ পড়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় সড়ক থেকে গাছ সরিয়ে নিলে এক ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। ঝড়ে পদুয়া ইউনিয়নের পশ্চিম খুরুশিয়ার চিপছড়ি পাড়া, পেকুয়া পাড়া এলাকায় পাঁচটি বাড়ি ধসে পড়েছে। এছাড়াও পদুয়ার বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় বিভিন্ন স্থানে একাধিক গাছ পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কোদালা ইউপির সদস্য মিনু আরা বেগম জানান, তীব্র বৃষ্টিতে সদ্য নির্মিত কোদালা–শিলক সংযোগ সেতুর এপ্রোচ সড়কের একপাশে ধসে গেছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটি তাৎক্ষণিকভাবে সংস্কার করা হলেও পরক্ষণে তা আবার ধসে গেছে। হাজী সৈয়দ আলী সড়কের শিলক ইউনিয়নের ব্যুচক্র হাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর ভাঙনে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের পাশ ঘেঁষে ভেঙে গেছে তীর। সড়কের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে মাটি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান জানান, ভারী বৃষ্টিতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তেমন বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু পরিবারের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে তাদের সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হবে।
ফটিকছড়ি : ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, বন্যার আশঙ্কায় ভুগছে ফটিকছড়ি উপজেলার বাসিন্দারা। গত কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে এরই মধ্যে উপজেলার নদী খাল ও ছড়াতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে হালদা নদীর পানি গতকাল বুধবার সকাল থেকেই বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার হালদা নদীর নারায়ণহাট ইউনিয়ন অংশের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হলেও বেশ কিছু এলাকায় পানি বৃদ্ধি পাওয়াতে ঝুঁকি বাড়ছে। নাজিরহাট পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের মালি পাড়া অংশেও হালদার বাঁধ যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে বড় ধরনের বন্যার কবলে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সরেজমিনে দেখা যায়, জিও ব্যাগ থাকলেও বাধ ভাঙছে। মাত্র ২ ফুটের মত জায়গার মাটি সরে গেলেই বাধ ভেঙে পানি ঢুকতে পারে লোকালয়ে। আর এতে ক্ষতি হবে কয়েকশ ঘরবাড়ির।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বুধবার সকাল থেকেই হালদা নদীর পানি নারায়ণহাট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য পয়েন্টগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তবে এখনও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। জনসাধারণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।