আরো একটি ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করবে টানেল যুগে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উদযাপনে পুরো চট্টগ্রাম সাজছে বর্ণিল সাজে। বিশেষ করে টানেলের দুই প্রান্ত পতেঙ্গা ও আনোয়ারায় চলছে সাজসাজ রব।
টানেল উদ্বোধনের পর আনোয়ারা প্রান্তে কেইপিজেড মাঠে অনুষ্ঠিত হবে জনসভা। এই সভায় ১০ লাখ লোকের সমাগম ঘটাতে চলছে জোর প্রস্তুতি। স্থানীয় সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ জনসভা সফল করতে রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। গতকাল শুক্রবার বেলা দুইটায় ভূমিমন্ত্রী সরেজমিনে জনসভার মাঠ পরিদর্শন করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, কোরিয়ান ইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শাহজাহান, আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক এম এ মান্নান চৌধুরী, কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী, আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ সদস্য এস এম আলমগীর চৌধুরী, ভূমিমন্ত্রীর একান্ত সহকারী সচিব রিদওয়ানুল করিম চৌধুরী সায়েম, আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি আনোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান নোয়াব আলী, চেয়ারম্যান এম এ কাইছুম শাহ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাহাব উদ্দীন, সগীর আজাদ, আবদুল মালেক ও ভূমিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী এডভোকেট ইমরান হোসেন বাবু।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও জনসভার প্রস্তুতি কার্যক্রম তদারকিতে এলাকায় রয়েছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সফলতা তুলে ধরার পাশাপাশি বড় ধরনের শোডাউনে তাক লাগিয়ে দিতে চায় ক্ষমতাসীন দল। বড়সড় মাঠে চলছে মহাসমাবেশ আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি। ৮ ফুট উচ্চতায় ১৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৮ বর্গফুট প্রস্থের প্রায় ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের নৌকার আদলে মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে। যা মাঝারি আকারের প্রায় ৬টি ফ্ল্যাট বাড়ির সমান। নেতাকর্মীরা বলছেন এটি হবে দেশের এ যাবৎকালের বৃহত্তম মঞ্চ। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে চারটি বিশাল মাঠ। মঞ্চ তৈরির দায়িত্বে থাকা চিটাগাং ইভেন্টসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বললেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর চেয়ে বড় মঞ্চ তৈরি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধু টানেল যেমন ঐতিহাসিক তেমন মহাসমাবেশের সবকিছুও স্মরণীয় করে রাখার মতই তৈরি হচ্ছে।
ভূমিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এর মধ্যে কয়েকবার মহাসমাবেশের স্থান পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের মর্যাদাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মহাসমাবেশের মাধ্যমে সেই অর্জনকে সেলিব্রেট করতে চাই। প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে দিতে চাই চট্টগ্রামের মানুষ তাকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালবাসে। প্রধানমন্ত্রী জনসভায় নির্বাচনের চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দেবেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, টানেল চালু ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মহাসমাবেশের ঢেউ আগামী নির্বাচনে গিয়ে পড়বে। নেতকর্মীরা বেশ উচ্ছ্বসিত।
জনসভা ও টানেলের উদ্বোধন ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে বিলবোর্ড, ব্যানার ও পোস্টারে। সমাবেশ জনসমাগমে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগ কয়েকদফা বর্ধিত সভার মাধ্যমে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ইতিমধ্যে একাধিকবার পরীক্ষামূলক গাড়ি চলাচলও করেছে। উদ্বোধনের পরদিন ২৯ অক্টোবর থেকে টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
জানা যায়, টানেলে পায়ে হেঁটে পার হওয়ার সুযোগ থাকছে না। একইভাবে মোটরসাইকেল এবং তিন চাকার যানবাহনও চলাচল করতে পারবে না। ইতিমধ্যে কোনো যানবাহন থেকে কী ধরনের টোল নেওয়া হবে তা মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করেছে। টানেলে চলাচলে সর্বনিম্ন টোল ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। প্রাইভেটকার পারাপারে এই টোল দিতে হবে। প্রতিবার পিকআপ পারাপারে টোল ২০০ টাকা। মাইক্রোবাসের টোল ২৫০ টাকা। ৩১ আসনের কম বাসের টোল ৩০০ টাকা। ৩২ আসনের বেশি বাসের টোল ৪০০ টাকা। তিন এঙেল বিশিষ্ট বড় বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা।
পাঁচ টন পর্যন্ত পণ্য বহনে সক্ষম ট্রাকের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। আট টনের ট্রাক পারাপারে ৫০০ টাকা এবং ১১ টনের ট্রাকে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তিন এঙেলের ট্রেইলারে টোল লাগবে ৮০০ টাকা। চার এঙেলের ট্রেইলারে দিতে হবে এক হাজার টাকা। পরবর্তী প্রতি এঙেলের জন্য বাড়তি দিতে হবে ২০০ টাকা। টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দিন থেকে এই টোল হার কার্যকর হবে।
পতেঙ্গা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে এই টানেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি।
এই টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে কঙবাজারের দূরত্ব কমবে অন্তত ৫০ কিলোমিটার। আসবে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। নদীর তলদেশে ৪ লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে গাড়ি। সাশ্রয় হবে জ্বালানি ও সময়। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।