কয়েকদিন আগে একটা ডক্যুমেন্টরীতে নৌকা ভর্তি ৫০–৬০ জন লোক উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার দৃশ্য দেখেছিলাম। এই পথটি যে কতটা কণ্টকাকীর্ণ তা বলে বুঝানো যাবে না। যাত্রীরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অভুক্ত অবস্থায় গাদাগাদি করে তবেই গন্তব্যে পৌঁছায়। পথেই চিরতরে হারিয়ে যায় অনেকের ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন। মৃত্যু ও নিখোঁজ হওয়া নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। কিন্তু নিয়মিত মৃত্যু বা নিখোঁজের ঝুঁকিও মানুষের ভূমধ্যসাগর পাড়ি থামাতে পারছে না। নৌকাটি ঝড় ঝঞ্ঝা পেরিয়ে উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছা মাত্র নৌকায় থাকা যাত্রীরা লাফিয়ে নেমে দৌড়ে উঁচু দেয়াল পার হওয়ার চেস্টা করছে। দেয়ালটি প্রায় ১৫–২০ ফিট উঁচু, তার উপর লোহার গ্রিল যা আরো ১০–১৫ ফিট। দেয়ালের অপর পাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে নতুন আসা অভিবাসীদের জন্য অপেক্ষা করছে। অপরদিকে সাগরের তীরে বর্ডার সিকিউরিটির লোকজন অভিবাসীদের তীরে ভীড়তে বারণ করছে। যারা তাদের নাগালের মধ্যে আসছে তাদের গ্রেফতার করছে। কয়েক জনকে দেখলাম দেয়াল টপকিয়ে দেশটির মূল ভুখণ্ডে ঢুকতে চেষ্টা করছে। আর যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে।
মূল ভূখণ্ডে যারা ঢুকতে পারছেন তাদের মধ্যে কিছু লোক কয়েক বছর কষ্ট করার পর বেশ ভালো আছেন, বাড়িতে নিয়মিত টাকাপয়সা পাঠাচ্ছেন। তবে পৌঁছানো বেশিরভাগ লোক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন অড জব করছেন। কেউ কেউ এমন সব কাজ করছেন, যেখানে কাজ করে জীবনের একটা পর্যায়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে দেশে ফিরে আসেন। আর এসব দেখে বর্তমানের তরুণ যুবকেরা অবৈধ ভাবে ইউরোপ (ইতালি) যেতে আগ্রহী হচ্ছে। মৃত্যুর হাতছানি থাকলেও পরিবারের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার স্বপ্ন তাঁদের থামাতে পারছে না। অভিজ্ঞদের মতে দেশে কর্মসংস্থানের অভাবই মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ যাত্রার অন্যতম প্রধান কারণ। আর এজন্য নিরুপায় হয়ে ভাগ্য বদলাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটছেন তরুণেরা। দালালের প্রলোভনে আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ করে লাখ লাখ টাকা স্থানীয় দালালের হাতে তুলে দিচ্ছেন। তবে নিয়মিত ব্যবধানে ঘটা দুর্ঘটনায় ইউরোপ পাড়ির স্বপ্ন ডুবছে ভূমধ্যসাগরে। এটি আমার কথা নয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যের ভাষ্য এটি।তারা বলছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ এর জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৫ জন মানুষ। এর মধ্যে ইউরোপ পৌঁছেছেন ১১ লাখ ৬৪ হাজার ১৮ জন। সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের পুলিশের কাছে ধরা পড়েছেন ৪ লাখ ৭১ হাজার ৯৫৪ জন। সমুদ্রে ডুবে হারিয়ে গেছেন ১৯ হাজার ৫৬৩ জন। যাঁদের অনেকের লাশটাও পাওয়া যায়নি। কিন্তু যাত্রাটা কোন নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে না হওয়ায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সর্বশেষ ৭ আগস্ট‘ ২৩ ভূমধ্যসাগরে যে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার অন্তত ২০ জন ছিলেন। যার মধ্যে ১২ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৭ জন নিখোঁজ রয়েছে ও মাত্র ১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষও। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশের তালিকায় উৎস দেশের মধ্যে কয়েক বছর ধরে শীর্ষ তিনে আছে বাংলাদেশের নাম। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুলাই পর্যন্ত অবৈধভাবে ইতালি পৌঁছানো নাগরিকদের মধ্যে ১৯% তিউনিসিয়ার। ১৮% এর বেশি আছে মিসরের আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের নাগরিক আছেন প্রায় ১৪.৫%। তবে এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইতালি গেছে ২৯ হাজার ৭৭৮ জন।
গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে, নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার অন্তত ৮০০ লোক এভাবে দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইতালি গিয়ে এখন ভালো আছেন। তাঁদের দেখেই বর্তমানের তরুণ–যুবকেরা এভাবে ইটালি যেতে আগ্রহী হচ্ছেন। আগে ইতালি যাওয়ার জন্য দালালকে দিতে হতো ৮ লাখ টাকা, তিন মাস আগেও দিতে হতো ১০ লাখ কিন্তু এখন লাগছে ১২ লাখ টাকা। নিরুৎসাহিত করলেও লোভে পড়া তরুণদের এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা কোনওভাবে থামানো যাচ্ছে না। এদিকে আইওএম বলছে, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ বা মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে সমুদ্রে ডুবে। এ ছাড়া নৌযান দুর্ঘটনা, কঠিন পরিবেশ ও খাবারের সমস্যা, সহিংসতা, অসুস্থতাসহ নানা কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রতি মাসেই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। কোনও কোনও মাসে একাধিকবার দুর্ঘটনার খবরও আসছে। নৌকা ডুবিতে জুলাইয়ে হারিয়ে গেছে ৫৮ জন। এর আগে শুধু জুনে হারিয়ে গেছে ৭৪৯ জন।
আইওএম প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার ৮৪৫ জন হারিয়ে গেছেন সমুদ্রের পানিতে। ২০১৪ সালে হারিয়ে যান ৩,২৮৯ জন। এরপর সর্বোচ্চ নিখোঁজের ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে। ওই বছর হারিয়ে যান ৫,১৩৬ জন। ২০২০ সালে নিখোঁজ হন ১,৪৪৯ জন। তবে ২০২১ সালে ২,০৪৮ জন ও ২০২২ সালে ২,৪১১ জন হারিয়ে যান সমুদ্রে। আর এ বছরের ৮ মাসেই নিখোঁজ হয়েছেন ২,০৯৬ জন।
আগেই বলেছি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাচ্ছে যেসব দেশের নাগরিকেরা, তাদের মধ্যে শীর্ষ দেশগুলো হলো আফ্রিকার। এসব দেশ যুদ্ধসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। সিরিয়াও আছে এ তালিকায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের নামটাও থাকছে নিয়মিত।
বেসরকারি খাতের অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে,দারিদ্র্য বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ থেকে এসব অভিবাসন হচ্ছে না,এটি হচ্ছে মূলত বেকারত্ব ও হতাশা থেকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রম শক্তি জরিপ ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বা সম পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের মধ্যে বর্তমানে বেকারত্বের হার ১২% যা প্রায় ৮ লাখ। আর কোনও ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র ১% এর কিছু বেশি। তবে দেশে সার্বিক বেকারত্ব ৩.৫৩% যা প্রায় ২৫ লাখ ৮২ হাজার। বর্তমানে দেশে শ্রমশক্তির আকার ৭ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার। এতে কাজে নিয়োজিত আছেন ৭ কোটি ৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান মাত্র ১৫.১%। বাকি ৮৫% কর্মসংস্থান অনানুষ্ঠানিক খাতে। যেখানে চাকুরির কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিবিএস জরিপে অংশ নেয়া ৬ হাজার অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ১৮.৭% যুবক বলেছে সুযোগ পেলে তারা স্থায়ীভাবে বিদেশ চলে যাবে। যা দেশ ও জাতির জন্য অশনিসংকেত। কারণ সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী জনগোষ্ঠীর দেশ ত্যাগ অব্যাহত থাকলে একসময় দেশ মেধাশুন্য হয়ে পড়বে। যা সত্যিই দুশ্চিন্তার।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।