‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। ঠিক একইভাবে বিবেচনা করলে শিক্ষার্থী বিহীন বিদ্যাপীঠ যেন রুগ্ন, অসার, শূন্য উদ্যান। একজন কলেজ শিক্ষক হিসেবে প্রায় বারোটি বছর একই রুটিনে কলেজে যাওয়া, পড়ানো, পাঠ কার্যক্রমে গতানুগতিক কাজ যেন একঘেয়ে জীবন। কখনো কখনো এই একঘেয়েমি কাটাতে তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষায় থেকেছি ছুটি কখন পাওয়া যায়। ছুটিই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচার সঞ্জীবনী। কিন্তু কোভিড ১৯ এ অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘ ছুটি, নৈমিত্তিক ধরাবাঁধা জীবন হতে সরে গিয়ে মধ্যযুগে বসবাসের প্রথমটা উপভোগ করলেও একটি সময় প্রিয় শিক্ষাঙ্গণ, শিক্ষার্থীদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা কোলাহলের শূন্যতা ক্রমে চেপে বসে। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠা চঞ্চল, চপল চোখের হুটোপুটি কতোদিন চোখে পড়ার অভাবে যেন শিক্ষক অন্তর কেঁপে ওঠে। পরে বুঝতে বাকি রইলো না একটি শিক্ষকজীবন শিক্ষার্থী ছাড়া অসম্পূর্ণ।
কোভিড ১৯ সংক্রমণ সামলে উঠলে সকল বিদ্যাপীঠ খুলে দেয়ায় দেখা মিলতে শুরু করে আমাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের। আবার শুরু হলো উৎসবমুখর পরিবেশ কলেজ প্রাঙ্গণে। ছাত্র ছাত্রীদের পরিষ্কার পরিপাটি পোশাক, বন্ধুদের সাথে দীর্ঘদিন দেখা না হওয়ায় তৃষিত মনের আনন্দে ফেটে পড়তে চাওয়া চোখের চাহনি। কিছুই আমার চোখের আড়াল হতে চায় না। হয়তো তাদের আনন্দের মাঝে নিজের হারিয়ে যাওয়া শৈশব খুঁজে ফিরছি। কিংবাএকাডেমিক কাজে শিক্ষার্থী বিহীন শূন্য, ফাঁকা কলেজে গেলে যে হাহাকার তৈরি হয়েছিল হয়তো তারই মলম লাগাচ্ছিলাম তাদের দেখে।
কিন্তু এরই মাঝে আরেকটি বিষয় যা বরাবরই ভাবিয়ে তুলছে তা হলো উল্লেখযোগ্য হারে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া। কোভিড ১৯ এ দেশে দারিদ্র্যের হার চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। যে কারণে সংসার চালানো যেখানে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে সন্তানে পড়াশোনা চালানো অনেকটা বিলাসিতা হিসেবে বিবেচ্য হয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। তবে করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। তিন গুণ বেড়ে এটি এখন হয়েছে ২৮.৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের মুখোমুখি ৫৬ শতাংশ পরিবার দাবি করেছে, করোনার সময় তাদের আয় কমেছে।
সরকার যদিও শুরু থেকেই প্রণোদনা দিয়ে এসেছেন তা সত্ত্বেও তা খুব বেশি একটা কার্যকর হয়নি। যেজন্য পরিবারের শিশুরা স্কুল কলেজ বাদ দিয়ে অর্থ আয়ে মনোযোগী হয়েছে। বেড়েছে শিশুশ্রম। করোনাকালে যত্রতত্র শিশুশ্রমিকের দেখা মেলে। বিশেষ করে বিভিন্ন কারখানা, ওয়ার্কশপ, মুদি দোকান, হোটেল, পরিবহনে শিশুরা কাজ করছে।
আবার যে জিনিসটি বেশি চোখে পড়েছে তা হলো বাল্যবিয়ে। এই কোভিডে উল্লেখযোগ্য হারে বাল্য বিবাহ বেড়েছে যা থামাতে প্রশাসনিক তৎপরতাও খুব বেশি কার্যকর হয়নি। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ তাদের এক গবেষণায় বলছে, ‘করোনাকালে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫ টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এ রকম সাত মাসে ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের তথ্য তাদের হাতে রয়েছে। যার অন্যতম কারণ এই দারিদ্র্য।
শিক্ষা খাতের সংশ্লিষ্ট নানা গবেষণায় বলা হয়েছে, স্বাভাবিক সময়েই প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। কিন্তু এখন অবস্থা আরো বেশি ভয়াবহ। সরকার যেখানে শিক্ষা হার বৃদ্ধিতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানে ১৯ মহামারীতে শিক্ষা খাতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশে, প্রায় ১৬০ কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বিষয়ে জাতিসংঘের এক নথিতে বলা হয়েছে, করোনাকালীন নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়তে পারে ২ কোটি ৩৮ লাখেরও বেশি শিশু ও তরুণ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত মে মাসে কভিড-১৯-সংক্রান্ত যে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, সেখানেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সেভ দ্যা চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মহামারীর কারণে বিশ্বে ৯৭ লাখ শিশুর হয়তো আর ক্লাসে ফেরা হবে না। শিক্ষার্থীদের এ ঝরে পড়া নিয়ে সরকারও চিন্তিত এবং এটির হার কমানো সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই করোনা পরবর্তী স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু এবং শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে নানামুখী কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্টমন্ত্রণালয় ও দপ্তর। পাঁচ বছরের একটি প্রকল্প নিচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কর্মসূচির মাধ্যমে দুপুরের খাবার সরবরাহ করবে, প্রতিটি স্কুলে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করবে এবং শিক্ষার প্রচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে উপজেলা পর্যায়ে মনোবিদ নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ভবিষ্যতে লেখাপড়ার ক্ষতি এড়াতে সারা বছর টেলিভিশন, রেডিও ও ইন্টারনেটে পাঠদান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক এবং বেসিন স্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয়ের আরও একটি পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা যাচাইয়ের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হবে। শিক্ষক স্বল্পতার নিরসনে আরও ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য শিক্ষাঋণ প্রদানের কথাও ভাবা হচ্ছে।
প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিশেষত যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস, যাদের সাথে শহরতলীর যোগাযোগ কম তাদেরে অবস্থা একটু বেশিই করুণ বলা যায়। তাই সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি তাই বেসরকারি স্কুল কলেজ নিজেদের শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতিপূরণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা করতে পারে। প্রতিকারমূলক শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিতে কাজ করতে পারে যেন শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনায় পুনরায় ফিরে যেতে পারে।
বিশেষ করে বস্তিতে বসবাসরত এবং গ্রামীণ জনপদে যেসব শিশুরা হতদরিদ্র পরিবারে বসবাস করে তাদের স্কুল ফি মওকুফ করা যেতে পারে যেহেতু করোনার ফলে তাদের পরিবারের রোজগার অনেকাংশেই কমেছে। শিশুদের স্কুলে ধরে রাখতে স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়নও জরুরি। বিশেষ করে, মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য হাইজিন ব্যবস্থা জোরালো না করলে মেয়েরা স্কুলে যেতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
স্কুল বা কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি এবং স্কুল বা কলেজের কেবিনেটের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে শিক্ষাভাতা হিসেবে আর্থিক সহায়তা প্রদান, বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি নেয়া যেতে পারে।
সক্রেটিসের ভাষায় ‘শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ’। তাই সব কিছুর পরে যে কথাটি অবশ্যই বলা প্রয়োজন তাহলো, সরকারি বা বেসরকারি যে উদ্যোগ যতই নেয়া হোক না কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা আর মানুষ ও দেশের জন্য ভালোবাসা। কারণ সবাই যদি সর্বান্তকরণে ভালোবেসে চেষ্টা করে তবে হয়তো এর হার অনেকখানি হ্রাস করা সম্ভব। একটি উল্লেখযোগ্য হারে যদি শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন হতে সটকে পড়ে তবে দেশের একটি শতাংশ মানুষ পিছিয়ে পড়বে। আর পিছিয়ে পড়া মানুষ নিয়ে দেশ এগিয়ে যাওয়া অনেকটা দুষ্কর বলা যায়।
ঝরা পাতায় নাম না লেখাক আর আমাদের কোনো শিশু কিশোর। শিক্ষার সাথে আত্মোন্নয়ন, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে যাক দুর্বার গতিতে। আমাদের বিদ্যাপীঠ থাকুক ফুলে ফলে সজ্জিত আমাদের আগামী প্রজন্মের সাথে। তাদের চোখেই দেখতে চাই আমাদের আগামী বাংলাদেশ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ওমরগণি এমইএস কলেজ