১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্র করে এদেশের কতিপয় বিপদগামী সৈকিকের মাধ্যমে আমার পিতাকে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে তাঁর শিশু সন্তান রাসেল সহ নির্মমভাবে হত্যা করে এদেশকে পুনরায় তাবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। সেই থেকে ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে শোকের দিন, আগস্ট শোকের মাস। এই শোকের মাসকে ঘিরে ‘শৈলী প্রকাশন’ আয়োজন করেছে ১ আগস্ট হতে ১৫ আগস্ট ‘জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক ১৫ দিন ব্যাপী সেমিনার, কবিতা পাঠ ও বই মেলার।
প্রতিদিনের আয়োজনে বিষয়ভিত্তিক সেমিনার আলোচনা সত্যিকার অর্থে অসাধারণ। যেমন– ১. বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ ও নির্দেশনা, ২. বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র চিন্তা, ৩. বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা, ৪. ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর ভাষা চিন্তা, ৫. বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র চিন্তা ৬. বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্র চিন্তা, ৭. বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্রপ্রেম, ৮. বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতার ভূমিকা, ৯. বঙ্গবন্ধুর নজরুলপ্রীতি, ১০. বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি ভাবনা, ১১. তারুণ্যের রোলমডেল বঙ্গবন্ধু, ১২. বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞানচিন্তা, ১৩. বঙ্গবন্ধুর লেখকসত্তা, ১৪. বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা ১৫. বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক চিন্তা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেছেন দেশের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক–গবেষকরা। যারা ১৫ দিন ব্যাপী সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন, আমার ধারণা তারা প্রত্যেকে একেকজন বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গবেষকে পরিণত হয়েছেন।
এভাবে নানা সময়ে ‘শৈলী প্রকাশন’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠানাদি আয়োজন করে থাকে। শৈলী প্রকাশন থেকে প্রথম যে বইটি বের হয়েছিল, তার নাম হলো ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার : ইতিহাসের নিষিদ্ধ সংলাপ’। সেই থেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁদের পথচলা। বইটির লেখক ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার সিরু বাঙালি। প্রকাশনা সংস্থাটির কর্ণধার রাশেদ রউফ। চারিদিকে ডিজিএফআই, এনএসআই সহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর রক্তচক্ষু, ভীতিকর পরিবেশ বঙ্গবন্ধু একটি নিষিদ্ধ নাম। সে সময়ে যে দুঃসাহসিক কাজটি শৈলী প্রকাশন এবং রাশেদ রউফ করেছিলেন তা এক কথায় অসাধারণ একটি কাজ। বর্তমান সময়ে অনুকূল পরিবেশে আজ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেমিনার কবিতাপাঠ ও বই মেলার আয়োজন হচ্ছে। সে সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বা কোনো কাজ করা যে কত কঠিন ছিল তা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও চিন্তা করা যায় না।
‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও ইতিহাসের নিষিদ্ধ সংলাপ’ বইটি প্রকাশনা করা ছাড়াও তারই নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু লেখক সম্মিলন পরিষদ’ নামক একটি সংগঠন। সেই ১৯৯৫ হতে আজ পর্যন্ত নিরলসভাবে অনুকূল বা প্রতিকূল প্রতিক্ষণে ‘শৈলী প্রকাশন ও রাশেদ রউফ’ বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে প্রতি বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন নামে বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনুষ্ঠানের ঢালি সাজান প্রতিনিয়ত। এছাড়াও প্রতিবছর আয়োজন করেন ‘শেখ রাসেল ছোটোদের বইমেলার’। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার এবং শ্রদ্ধার বিষয়ে রাশেদ রউফের স্থান অনেক অনেক উঁচুতে।
কিছুদিন আগে বিশেষকাজে ভারত ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে হলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত স্থান ‘ইসলামিয়া কলেজ’ বর্তমান হাজি মহসিন কলেজ এর ‘বেকার হোস্টেলের’ রুম নং– ২৪। ঐতিহাসিক স্থানটি দর্শন করে যাবো। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম রুমটি তালাবদ্ধ, পরিদর্শন করতে হলে ‘বাংলাদেশ হাই কমিশনের অনুমতি নিতে হবে’ যা খুবই দুঃখজনক। মনে খুব খুব কষ্ট পেলাম। মনের কষ্টটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর জানানো প্রয়োজন মনে করছি।
বঙ্গবন্ধু শুধু রাষ্ট্র নায়ক নন, তিনি সাধারণ মানুষের নেতা, সাধারণ মানুষের জন্যই রাজনীতি করেছেন। হাজি মহসিন কলেজ ও বেকার হোস্টেল সংলগ্ন মারকুইস্ ষ্ট্রীট, রিপন ষ্ট্রীট, কলকাতা নিউ মার্কেট (হগ মার্কেট) ইত্যাদি এলাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি ভ্রমণ করেন। বাঙালি যারা ভ্রমণ করেন তাঁদের কেউ জানেন না মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটা পথে জাতির জনকের স্মৃতি বিজড়িত কলকাতার জীবনের বিশাল স্মৃতি বিদ্যমান। সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে জানা তো দূরে থাক যারা জানে তা দর্শনের জন্য সেখানে ঢুকতে হলে হাই কমিশনের অনুমতির প্রয়োজন হবে। কী লজ্জা! বঙ্গবন্ধুকে তালার মধ্যে আবদ্ধ রাখা হলো কেন? বিশ্বের কোথাও কোনো জাতীয় নেতার স্মৃতি বিজড়িত স্থানকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় না। হয়ত নিরাপত্তার খাতিরে কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এভাবে একটি ইতিহাসকে তালাবদ্ধ করে রাখার কী রকম সিদ্ধান্ত আমার বোধগম্য নয়। মাননীয় নেত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলছি,
‘আমি জানিনা বিষয়টি আপনার নজরে আছে কিনা? যদি থাকত তবে এরকম হওয়ার কথা ছিল না। বেশি কিছু বলার নেই। বঙ্গবন্ধু জনগণের নেতা। সুতরাং তাঁকে জনগণের মাঝে থাকতে দিন। জনগণ হতে আলাদা করে হাইকমিশনের ঝুঁড়িতে বন্দি করে রাখা করা সমীচিন হবে না। সাধারণ জনগণের জন্য এবং দেখার জন্য এটি উম্মুক্ত করে দিন। আমি আশা করব কলকাতার বেকার হোস্টেলের ২৪ নং কক্ষটি সাধারণের জন্য অতিসত্বর উম্মুক্ত হবে এবং ভ্রমনকারীদেরকে তা দেখতে উৎসাহিত করা হবে।’
আপনারাতো জানেন ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ অভিন্ন। কিন্তু এই বাংলাদেশ নামটিও যে বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেটি আমাদের অনেকেই হয়ত জানেন না। ১৯৬৯ এর ৫ মে হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এক সময় এদেশের বুক হতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে–একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যাই নাই। —- জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ হবে। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ঃ ২৭৯)।
বাংলাদেশে থাকবে, বাংলাদেশের নাম নিয়ে রাজনীতি করবে অথচ বাংলাদেশের নামের যিনি প্রবক্তা যিনি বাংলাদেশ নামক একটি ভূখণ্ড উপহার দিয়েছেন তাঁর নামটি নিতে তাদের এত সংকোচ কেন? বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে যাদের এত সংকোচ তাদের এদেশে থেকে কি রাজনীতি করার অধিকার থাকে? আমি এদেশের একজন শহীদ পরিবারের সন্তান। এদেশের জাতীয় পতাকার লাল রক্ত বলয়ের সাথে আমার রক্তও রয়েছে। আমাদের রক্তে রঞ্জিত এ বাংলার ইতিহাস। সে হিসেবে শহীদ পরিবারের একজন সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। জয় বাংলা– জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক–শিল্পশৈলী।