‘জুলিও কুরি’ শান্তি পুরস্কার–১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যা বয়ে এনেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বিশ্বশান্তির অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ‘জুলিও কুরি’ এই নামকরণটি হয় নোবেল পুরস্কার জয়ী ফরাসী পদার্থ বিজ্ঞানী ‘জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি’র এর নামানুসারে। জুলিও কুরির ফরাসী উচ্চারণ ‘জোলিও কুরি’। ১৯৫৮ সালে জঁ ফ্রেডেরিকের মৃত্যু হয়। বিশ্বশান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম রাখে ‘জোলিও কুরি’। কুরি দম্পতি তাদের গবেষণায় পলোনিয়াম ও রেডিয়ামের মৌল উদ্ভাবনের ফলে পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তাদের স্মরণে বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে পদকটি প্রবর্তন করে।
ফ্রেডেরিকের স্ত্রী ‘ইরেন কুরিও বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনিও পদবি গ্রহণ করে ‘ইরেন জোলিও কুরি’ হন। তারা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার জয়ী হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রেডেরিক জেলিও কুরি শুধু বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করেননি। গেরিলা বাহিনী গঠন করেন এবং গেরিলাদের জন্য অস্ত্র তৈরী করেন। তাদের এই অবদানের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ত্বরান্নিত হয়। বিশ্বশান্তি স্থাপনে তাদের সংগ্রাম চির স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি’ বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতি ছিলেন। এই শান্তি পুরস্কার তাদেরকে দেওয়া হয় যারা সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা করে। শোষিতের পক্ষে কাজ করে। সমাজে বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ কাজ করে এবং মানবতা ও বিশ্বশান্তিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। ২৩ মে ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহানায়কের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন এই পদক। এই পদক ছিল বঙ্গবন্ধুকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান। পদক প্রদানের ব্যাপারে বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় ১৪০টি দেশের ২০০ সদস্যের উপস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ১০ অক্টোবর ১৯৭২ স্বাধীনতার পরের বছর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে এই শান্তি পদকের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৩ সালের মে মাসে এশিয়া পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্সর দুই দিনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। সেখানে আন্তর্জাতিক কুটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে পদকটি পড়িয়ে দেন তৎকালীন বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল রমেশ চন্দ্র। রমেশ চন্দ্র তাঁর ভাষণে বলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নয়, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে ঐ পদকে ভূষিত করার বিবেচনার মানদণ্ড ছিল তাঁর সারা জীবনের দর্শন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের প্রেক্ষাপট। একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মুক্তিকামীদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে তারা বিবেচনায় এনেছিল তাঁর ছাত্র–জীবনের সংগ্রামী মনোভাব, শোষিতের জন্য কাজ করা, সর্বোপরি একটা দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি। তাঁর রাজনীতির মাঠে ছিল অহিংস নীতি ও শান্তির মাধ্যমে সামনে চলা। সংগ্রাম করতে গিয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছিলেন। নতুন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে ১৯৫২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনস পিস কনফারেন্সে তিনি যোগদান করেন। সেখানে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সাথে মত বিনিময় হয়। ১৯৫৬ সালে এপ্রিল মাসে স্টকহোমে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনে যোগ দেন। উপস্থিত সবাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। “নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ যেকোন দেশেরই হোক, আমি তাদের সাথে থাকবো”, “আমি চাই বিশ্বের সর্বত্রই শান্তি বজায় থাকুক”। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন শান্তির অন্বেষণে নিবেদিত ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি সবসময় এশিয়া–আফ্রিকা–ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের সমর্থক। শান্তি ও মানবতায় আত্ননিয়োগ করে বঙ্গবন্ধু দেখেছেন শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, অশান্তি, সাম্রাজ্যবাদীদের উত্থান। তিনি বলতেন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণে ব্যয় হোক। তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই পৃথিবী শোষক আর শোষিত দুইভাগে বিভক্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতার মূল আদর্শ, বাক্য ও ভাবনা নিজে পোষণ করেন। তাঁর পররাষ্ট্র নীতি ও সকলের সাথে বন্ধুত্ব– কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। তিনি বিশ্বের যুদ্ধবাজ ও বৃহৎ শক্তিদের আহবান জানান–আর যুদ্ধ নয়। বিশ্ব খাদ্য সংকট ও দুর্মূল্যের দিনে যুদ্ধের সেই অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করা হোক। শান্তি কামনায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে কোন সামরিক জোটে ভিড়াননি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে কাজ করার আহবান জানান। নিরস্ত্রীকরণ প্রস্তাবে তার শতভাগ সমর্থন ছিল। তিনি বর্ণবাদ নীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। ইসরাইলের জোর পূর্বক দখলদারিত্বে ঘোর বিরোধী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই সমস্ত দৃঢ়চেতা মনোভাব, বক্তব্য, শান্তির অন্বেষা আজও বিশ্বশান্তি ও সম্প্রীতির সহায়ক। কত বড় গুণী বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য না হয়েও আন্তর্জাতিক বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন যেটা আজও মানুষের মনকে নাড়া দেয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই মহান ব্যক্তির মৃত্যু নেই। তিনি অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।