জুলাই জাতীয় সনদে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে অস্বীকার’ করার প্রয়াস চালানো হয়েছে দাবি করে আপত্তি থাকা বিষয়গুলো নিয়ে আন্দোলনে নামার কথা বলেছে বাম ধারার চারটি দল। দীর্ঘ এক বছর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সংস্কারে যে যেসব উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকার সম্বলিত জুলাই জাতীয় সনদে এসব দল সই করেনি।
ইতিহাস ‘সঠিকভাবে না আসা’ এবং সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন নিয়ে আপত্তির কারণে বাম ধারার চারটি দল আগেই সনদে সই না করার ঘোষণা দিয়েছিল। দলগুলো হল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ঙবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ। এসব দলের নেতারা বলছেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে যে অর্জন তা ‘মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা ও সংবিধানের চার মূলনীতি অস্বীকারের’ প্রয়াসের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জনগণের কাছে তুলে ধরতে চান চার দলের নেতারা। খবর বিডিনিউজের।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, আমাদের কথা ছিল সংবিধানের চার মূলনীতি ঠিক রেখে কেউ যদি মনে আরও যুক্ত করতে চায় এবং এই চার মূলনীতির সঙ্গে অসংতিপূর্ণ না হয়, তাইলে বাড়াইতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা মনে করি বাড়ানোর দরকার নাই, কিন্তু তারপরও যেহেতু অনেকেই এখানে আছে, বাড়াইতে চায়। কিন্তু ওনারা তো এটা পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এই কারণে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করি নাই, আমরা সেটা নিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরবো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, তারা তাদেরটাই ঠিক রেখেছে। ফলাফলটা কী? দেশের অবস্থা দেখেন কোথাও ঠিক নাই। তাদের সক্ষমতা নেই, দেশের আইন শৃঙ্খলা বা পরিস্থিতি দেখেন।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্যে কিছু পরিবর্তন করা দরকার, সংশোধন করা দরকার, আইন–কানুন বিধি–বিধানে কিছু সংস্কার দরকার, সেজন্য ঐক্যমত কমিশন হল। আমরা কিন্তু আগাগোড়াই গত সাত–আট মাস ধরেই, আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করছি। প্রধান উপদেষ্টা আমাদেরকে গত বছরের ৫ অক্টোবর বলছিলেন, যে সব দল যেটাই একমত হবে সেটাই হবে ঐকমত্য। আমরাও বলেছি সব দল যেটাতে একমত হবে সেটাই ঐকমত্য, কিন্তু ঐক্যমত কমিশনের সবাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত, মানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়া সেগুলো ঐকমত্য করল।
তিনি বলেন, এটা জনগণের সঙ্গে এক ধরনের একটা প্রতারণা। কারণ সবাই যেটা একমত হয় নাই, সেটাকে ঐক্যমত বলে প্রচার করা সেটা তো জনগণকে বিভ্রান্ত করা। আমরা সেটাকে ঠিক মনে করি নাই। আমরা বলছি সর্বসম্মত যে সিদ্ধান্ত সেটাকে ঐকমত্য হিসেবে জাতীয় জুলাই জাতীয় সনদ করুক, আমরা সবাই মিলে স্বাক্ষর করবো।
ফিরোজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাস, সেগুলো ভালোভাবে সঠিকভাবে সেখানে লিপিবদ্ধ হয় নাই। সেটা নিয়ে আমরা বারে বারে সংশোধনী দিছি। তারা সেটা সংশোধন করে নাই।
তিনি বলেন, সুপারিশের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তফসিলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণাপত্র, ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার যেটা ঘোষণা করছিল, তার ভিত্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেটা বাদ দিছে। আবার জুলাই সনদ হচ্ছে, এটাকে আবার তফসিলের মধ্যে ঢুকানো হবে। রাষ্ট্রের মূলনীতি আমরা বলছিলাম, আপনারা যেটা যুক্ত করতে চাইতেছেন-‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্মীয় স্বাধীনতা সমপ্রীতি’, এগুলো যুক্ত করেন, আমাদের আপত্তি নাই, কিন্তু আগেরটা রেখে। আগের চারটা রেখে যুক্ত করলে আমাদের আপত্তি নাই, এটা আমরা বারবার বলছি তারা আগের চারটা বাদ দিয়ে নতুন করে যুক্ত করছে সেটা আমাদের গুরুতর আপত্তি। মূলনীতি থেকে স্বাধীনতার ঘোষণত্র বাদ দেওয়া, এগুলো মানা যায় না।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সবচেয়ে গুরুতর বিষয়, আপত্তির বিষয় হলো অঙ্গীকার নামায় যে সাত দফা দিছে, সেখানে প্রথম দফা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। তাইলে নোট অব ডিসেন্টসহ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কেমনে করবে? এটা বোধগম্য না। এটা সংবিধানের তফসিলে বা যথাপযুক্ত জায়গায় স্থান দিবে। নোট অব ডিসেন্টগুলো এত বড়, নোট অব ডিসেন্ট এতগুলো, তফসিলের মধ্যে কেমনে যুক্ত করবে? এটা আমরা ঠিক মনে করি না। এটা নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হইতে পারবে না, এটা কি ব্যাপার? যেটা মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার, সে অধিকারের পরিবর্তি হয়? সেজন্য আমরা বলছি, ঐকমত্য কমিশন বাস্তবায়নের নামে বিভক্তি, অনৈক্য তৈরি করার একটা প্রয়াস সেখানে চালিয়েছে।
এই আপত্তি নিয়ে আন্দোলনে নামার কথা জানিয়ে বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, আমরা আমাদের কথাগুলো নিয়ে জনগণের কাছে যাব, জনগণের কাছে প্রচার করব। এরা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র সেগুলো বাদ দিয়ে আসলে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিতে চায়। এখানে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চায়। অনেকে এটাকে ৪৭ সালে নিয়ে যেতে চায়, সেই পাকিস্তানের ধারায়।
বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, বাংলাদেশের একটা গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের চাওয়াটা আমাদের আছে বলেই তো আমরা ঐকমত্য কমিশনের সভাগুলোতে গিয়েছি এবং আমরা আমাদের মতামতগুলো দিয়েছি তর্ক–বিতর্ক করেছি, আলাপ আলোচনা করেছি। আমরা যেটা চেয়েছিলাম যে ন্যূনতম যে ঐক্য, ন্যূনতম যে ঐক্যের ভিত্তি, তার ভিত্তিতে তো একটা দেশ পরিচালিত হওয়া উচিত। মানে এরকম সনদ হওয়া উচিত। যেগুলা একমত হয়েছিলাম, সেগুলা কিন্তু একটা গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য, একটা যাত্রা শুরু হওয়ার জন্য অনেক বড় একটা পদক্ষেপ। আলোচনায় আমাদের যে অর্জনের জায়গা সেই অর্জনগুলোর জায়গা প্রশ্নবিদ্ধ হলো আর কি। এখন এটা প্রশ্নবিদ্ধ হলো, এটাকে কেন্দ্র করে দেশ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে যাবে বা যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করেছে।
মাসুদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন সচেতনভাবে এখানে একটা বিভাজন তৈরি করছে। এগুলো অবশ্যই আমাদের দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরবো। যেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করে দেয়, তার বিরুদ্ধে যাতে জনগণ সোচ্চার হয়, সেটা অবশ্যই আমরা করবো। জনগণের মধ্যে আমাদের এই বক্তব্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।
সিপিবি সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, এই সনদ স্বাক্ষরের পরে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হল, আমরা দেশবাসীর সামনে নানা ধরনের কর্মসূচি, সভা–সমাবেশের ভেতর দিয়ে আমরা জুলাই সনদে কেন স্বাক্ষর করিনি সেটা আমরা জানাবো আমরা বলব। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, বাহাত্তরের সংবিধান প্রশ্নে কোনো ছাড় আমরা দিচ্ছি না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, বিকৃত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ মানে যে আওয়ামী লীগ না, মুক্তিযুদ্ধ মানে যে বাম প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ, সেটাই আমরা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাই।