জুলাই জাতীয় সনদ চারটি উপায়ে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন; এর মধ্যে দুটি সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এসেছে। জামায়াতে ইসলামীর তরফে নতুন একটি প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেছেন দলটির নেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হওয়ার পর প্রস্তাব তুলে ধরে ঐকমত্য কমিশন। গণমাধ্যমে আসা কাগজে ছয়টি প্রস্তাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত চারটি প্রস্তাব রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে আসা এই ছয়টি প্রস্তাব হল– পূর্ণাঙ্গ সনদ বা তার কিছু অংশ নিয়ে গণভোট। রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা বলে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন। নির্বাচনের মধ্যে একটি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ। ত্রয়োদশ সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাস্তবায়ন। সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভা রূপে প্রতিষ্ঠিত করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে এই মর্মে মতামত চাওয়া যে, অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা। খবর বিডিনিউজের।
অপর দিকে বিশেষজ্ঞ প্যানেল একাধিক বৈঠকে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প বিবেচনা করে প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচ পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্যে সুপারিশ করে; এগুলো হচ্ছে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এবং ১০৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়া। পরে বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়সমূহকে (যার মধ্যে ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট আছে) চারভাবে বাস্তবায়নের জন্যে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষেজ্ঞরা। এই চারটি উপায় হচ্ছে– অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ। এর বাইরে আরো একটি প্রস্তাব তুলে ধরে সমর্থন দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। বৈঠকের বিরতিতে বের হয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চারটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেখানে জামায়াতের একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। আশা করি, এই পাঁচটি প্রস্তাবের মধ্যে আমরা কাছাকাছি আসতে পারব এবং জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি হবে। জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
জামায়াতের দেওয়া প্রস্তাব প্রসঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া দলটির প্রতিনিধি আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আমরা একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কথা বলেছি। অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশন যেসব বিষয়ে একমত পোষণ করেছে, এর মধ্যে যে বিষয়গুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সেগুলোকে একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে সংবিধানের উপরে প্রাধান্য দেওয়া। বাকি ক্ষেত্রে সংবিধান যেমন আছে, তেমনি থাকবে। ৫ আগস্ট জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ বাস্তবায়ন করার জন্যই সকল আলোচনা চলছে। গণঅভ্যুত্থানের পর যখন কোনো সংবিধান ছিল না, যখন দেশে কোনো সরকার ছিল না, বিচার বিভাগ ছিল না– সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী এই সময়ে জনগণের ইচ্ছা কার্যকর ছিল।
তার মতে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, জনগণের ইচ্ছার যে চরম বহিঃপ্রকাশ, এই বহিঃপ্রকাশকে একটি বিশেষ আদেশের মাধ্যমে প্রাধান্য দেওয়া হলে আগামী নির্বাচন জুলাই সনদের অধীনে হওয়ার পথে কোনো বাধা থাকবে না। শিশির মনির বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার ব্যবস্থায় সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসরণ করার সুযোগ না থাকায় সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদের মধ্যে ৫৭টি অনুচ্ছেদ ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। এজন্য আমরা বলেছি, একটি নতুন সাংবিধানিক আদেশ জারি করার জন্য। একটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি করে আগামীতে সংবিধানের উপরে বিশেষ সাংবিধানিক আইনকে প্রাধান্য দিয়ে ৫ আগস্ট থেকে কার্যকর দেখাতে। তাহের বলেন, গণভোটের প্রস্তাবকে বিকল্প হিসেবে রেখেছি। বিশেষ সাংবিধানিক আইন জারির প্রস্তাবের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে গণভোটের মাধ্যমে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, আমরা বলেছি, এই সরকার বর্তমান সংবিধান অনুসরণ করে গঠন করা হয়েছে। তাই বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী সাংবিধানিক কোনো বিষয়ের ব্যাপারে সংসদ ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নাই। এমন কি গণভোট করাও সম্ভব না, গণভোট করতে হলে সেখানে সংসদে সংবিধানে পরিবর্তন এনে পরে করতে হবে। এর বাইরে কিছু কিছু বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে। আর আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবো যদি অঙ্গীকার নেওয়া হয় যে আগামী সসদে গিয়ে আমরা এগুলো বাস্তবায়ন করবো, আর যেসব বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করা মত সেগুলো করা হবে। পুরো জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ দুইটি প্রস্তাবের বিষয়ে একমত হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, যে বিষয়গুলো অধ্যাদেশ জারি করে এবং নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সেগুলো সরকার ঠিক করবে এবং বাস্তবায়ন করবে। বৈঠকে সিপিবি ছাড়া ২৯ দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।