আল কুরআনের আলোকে কলেমার তাৎপর্য:
তাওহীদ ও রিসালাতে বিশ্বাসী মু’মিন নর–নারীদের ভিত্তিমূলে কলেমা তৈয়্যবাহ’র গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আপনি কি লক্ষ্য করেননি! আল্লাহ কীভাবে উপামা দিলেন, পবিত্র কলেমার? যেমন পবিত্র বৃক্ষ যার মূল সুদৃঢ় এবং শাখা প্রশাখা আসমানে। (সূরা: ইবরাহীম, পারা: ১৩, আয়াত: ২৪)
যেমন সুদৃঢ় বৃক্ষের শিকড়গুলো মাটিতে প্রসারিত হয়ে থাকে আর শাখা প্রশাখাগুলো উপরের দিকে চলে যায় তেমনিভাবে কলেমা তৈয়্যবাহ ও অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তার শাখা প্রশাখা গুলো শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। তখন চক্ষু কর্ণ নাসিকা ইত্যাদিকে গুনাহের কাজ থেকে রক্ষা করে। (তাফসীর নুরুল ইরফান, সূরা: ইবরাহীম ২৪ নং: আয়াত, সংশ্লিষ্ট তাফসীর)
হাদীস শরীফের আলোকে কলেমার তাৎপর্য:
হযরত ওবাদাহ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এরশাদ করতে শুনেছি, যে ব্যক্তি এ মর্মে সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যাতীত কোন মাবুদ নেই এবং নিশ্চয়ই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসূল। আল্লাহ তা’আলা তার উপর জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। (মুসলিম শরীফ)
হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি এটা জেনে ও মেনে নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছে আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসলিম শরীফ)
বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বয়ের প্রথমটিতে কলেমা শরীফের দুই অংশ, দ্বিতীয় হাদীসে কলেমা শরীফের প্রথমাংশ উল্লেখ হয়েছে। এই কলেমা কায়মনোবাক্যে পাঠকারী কলেমার দাবী বাস্তবায়নকারীকে জান্নাতী বলা হয়েছে। এই কলেমা শরীফ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সেতু বন্ধন। এ কলেমা শরীফের আধ্যাত্মিক শক্তি এতো বেশী কার্যকর যে এ কলেমা পাঠ করা মাত্রই মানুষের জীবনে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে যায়, এ কলেমাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সাথে পাঠ না করার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত যে লোকটি জাহান্নামী ছিল সে লোকটি এই কলেমা শরীফ পাঠ করার পর মূহুর্তেই জান্নাতী হয়ে গেল। তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক পবিত্রায় এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসে গেলো, এ কারনেই দোজাহানের সরদার শাফায়াতের কান্ডারী মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি লা–ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলল সে জান্নাতী হয়ে গেল। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ২৫৬২)
হাদীস শরীফের আলোকে কলেমা শরীফের ফযীলত:
তাওহীদ ও রিসালতের প্রতি স্বীকৃতি ও পরিপূর্ণ বিশ্বাসই ঈমানের পূর্ণতা দান করে। তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস রিসালতের প্রতি অবজ্ঞা অবিশ্বাস অসম্মান অশ্রদ্ধা কুফরীর নামান্তর। নবীজি এরশাদ করেছেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই আর আমি আল্লাহর রাসূল। কোনো বান্দা যদি কোনো সন্দেহ সংশয় না রেখে এ দুটি বাক্য নিয়ে আল্লাহর নিকট হাজির হয় সে জান্নাতে যাবে তার অবস্থা যাই হোক না কেন? (তাবরানি, কাবীর ১/২১১)
কলেমা শরীফ আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত:
এই কলেমার প্রতিটি অক্ষর প্রতিটি শব্দ প্রতিটি বাক্য, আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত। এ কলেমার গুরুত্ব মাহাত্ন্য ফযীলত ও মর্যাদা বর্ণনাতীত অতুলনীয়। এ কলেমা শরীফ দিবা–রাত্রি সকাল সন্ধ্যা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানদের কন্ঠে উচ্চারিত। বিশ্ব মুসলমানদের অন্তরাত্নার গভীরে এ কলেমা প্রোথিত। এ কলেমার সুশীতল ছায়াতলে পৃথিবীর অগনিত মানুষ মুক্তির মোহনায় সমবেত ও আশ্রিত, সুখ শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধির অফুরন্ত সওগাত এ কলেমার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে ধ্বনিত ও সুরক্ষিত। নবীজি এরশাদ করেছেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য হে আল্লাহ তুমি এই কলেমা দিয়ে আমাকে প্রেরণ করেছ আমাকে এর আদেশ দিয়েছো, আমাকে এর ভিত্তিতে জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছো নিশ্চয় তুমি প্রতিশ্রুতির ব্যাতিক্রম করোনা। (তাবরানি কাবীর ৭/৩৪৭/৭১৬৩)
কলেমা শরীফের ভিত্তিতে জানমাল সুরক্ষিত থাকবে:
এ কলেমা শরীফ বিশ্ব মুসলমানের ঈমান ইসলামের রক্ষাকবচ, মুসলমানরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে কলেমার প্রতি অবমাননা, তাওহীদ ও রিসালতের প্রতি চরম ধৃষ্ঠতা ও অবমাননার শামিল। দ্বীনের শত্রুরা ইসলামের দুশমনেরা কলেমার আওয়াজ স্তব্ধ করার যতই অপচেষ্টা করুক, তারা কখনো সফল হবেনা। কলেমার হিফাজতের দায়িত্ব মহান আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করেছেন। মুসলমান মাত্রই তাওহীদ রিসালত কুরআন হাদীস নবী রসূল ইসলামী নিদর্শন ঐতিহ্য স্থাপনার প্রতি অবমাননা অসম্মান অপমান কখনো সহ্য করতে পারেনা। ইসলাম বিরুধী সকল প্রকার চক্রান্ত ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। এটাই কলেমার দাবী। হযরত ইয়াদ আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, লা–ইলাহা ইল্লাল্লাহু, এমন এক বাক্য যা আল্লাহর কাছে সম্মানিত, আল্লাহর কাছে এর একটি মর্যাদা আছে। যে সত্যনিষ্ঠ হয়ে এটি বলে আল্লাহ তা’আলা তাকে এর বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (কানযুল উম্মাল ১/৬৩–৬৪, ২২৭)
কলেমা শরীফ মৃত্যু যন্ত্রণা লঘব করে:
হযরত জাবির ইবনু আবদিল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহ বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) খলীফা মনোনীত হওয়ার পর আমি উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে তালহা ইবনু উবাদিল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উদ্দেশ্য বলতে শুনেছি ব্যাপার কী? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের পর আপনার চেহারা মলিন দেখতে পাচ্ছি সম্ভবত: হযরত আবু বকর (রা.) এর খলিফা মনোনীত হওয়া আপনার ভালো লাগেনি, হযরত তালহা (রা.) বলেন, আল্লাহর কাছে পানাহ চাই! আমার দুশ্চিন্তার কারণ হলো আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিলাম আমি এমন একটি বাক্য জানি, কোনও ব্যক্তি যদি তা মৃত্যুর সময় বলে তাহলে সে দেখতে পাবে, তাঁর আত্মা দেহ থেকে বের হবার সময় ঔই বাক্যের জন্য সতেজতা অনুভব করছে আর কিয়ামতের দিন সেটি হবে তার জন্য আলো স্বরূপ। (আহমদ ১/৩৭/২৫২)
কলেমা শরীফের ওসীলায় খ্রিস্টানের জান্নাত নসীব হলো:
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী (রা)’র দরবারে এক খ্রিস্টান যাতায়াত করত তিনদিন পর্যন্ত আসেনি হযরত হাসান বসরী খোজ নিয়ে জানতে পারলেন তিনি মৃত্যু শয্যায় শায়িত। হযরত হাসান বসরী কাশফের মাধ্যমে তার অবস্থা জানতে চাইলেন, খ্রিস্টান বলল আমার অবস্থা ভালো নয় জাহান্নাম অপেক্ষা করছে। আমার নেক আমল বলতে কিছু নেই, পুলসিরাত কিভাবে অতিক্রম করবো চিন্তায় আছি, করুণাময় আল্লাহর মেহেরবানী একমাত্র অবলম্বন, সামনে জান্নাত দেখতে পাচ্ছি কিন্তু জান্নাতে প্রবেশের চাবি আমার নেই। হযরত হাসান বসরী বললেন হতাশ হয়োনা, আমি তোমার জন্য জান্নাতের চাবি নিয়ে আসছি, এ কথা বলামাত্র খ্রিস্টান বলল আমি চাবি দেখতে পাচ্ছি, এ কথা বলতে দেরী নেই মুখে পড়া শুরু করলেন আশহাদু আল–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ “কলেমা” পড়ে মৃত্যু মুখে ঢলে পড়েন, তাঁর মৃত্যুর পর হযরত হাসান বসরী তাঁর নিকট মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন মৃত্যু কালে আমি কলেমা শরীফ পাঠ করেছি। কলেমা শরীফের বদৌলতে আল্লাহ তা’আলা আমাকে জান্নাত নসীব করেছেন। কলেমা শরীফের কেমন বিস্ময়কর শান! মৃত্যেুর সময় কলেমা নসীব হওয়ার কারনে আল্লাহ তাকে জান্নাতী বান্দা হিসেবে কবুল করে নিলেন। (নুযহাতুল মাজালিস, পৃ: ১৪, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৬৭)
নবীজি মিরাজ রজনীতে আরশ আজীমে কলেমা শরীফ দেখলেন:
ইমাম ইবনে আসাকির (রা.) হযরত মাওলা আলী (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি মিরাজের রজনীতে আরশে লিখা অবলোকন করেছি “লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ।” (আদদুরুল মনসুর ৫/পৃ: ২১৯), প্রখ্যাত তাফসীরকার হাদীস বিশারদ ও ইতিহাসবিদ আল্লামা ইমাম সামসুদ্দীন যাহাবী কলেমা শরীফকে “কলেমাতুল ঈমান” নামে আখ্যায়িত করেছেন, ঈমানের কলেমা হলো “লা–ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ।” (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৪/পৃ: ৩৯)
হে আল্লাহ! কলেমার আলোয় বিশ্বময় আলোকিত করুন, কলেমা শরীফের ফয়েজ বরকতে আমাদের ইহকাল পরকাল ধন্য করুন, আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ এরশাদুল কবির
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: বর্তমান ফিতনার যুগে মহিলারা মসজিদে জামাতে নামায আদায় করা কতটুকু শরীয়ত সম্মত জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: পুরুষের জন্য মসজিদে জামাত সহকারে নামায আদায় করা অধিক ফযীলতপূর্ণ যা কুরআন সুন্নাহর অসংখ্য দলিলাদির দ্বারা প্রমাণিত। তবে হাদীস শরীফের কোথাও মহিলাদের কে মসজিদে গিয়ে নামায আদায়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়নি। নারীদের জন্য মসজিদের চেয়ে নিজ ঘরে নামায আদায় করাকে উত্তম বলা হয়েছে। হযরত উম্মে হুমাইদ নামক একজন মহিলা সাহাবী যিনি হযরত আবু হুমাইদ সা–ঈদি এর স্ত্রী, তিনি রাসূলুল্লাহর পিছনে নামায পড়ার আগ্রহের কথা প্রকাশ করলে নবীজি তাঁকে বলেছিলেন তোমার বাড়িতে নামায আদায় করা তোমার মহল্লার মসজিদে নামায অপেক্ষা উত্তম। এর পর থেকে তিনি আজীবন নিজ ঘরের প্রকোষ্টে নামায আদায় করেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৭০৯০), ইসলামী শরীয়তে জমহুর ওলামায়ে কেরাম ও মুজতাহিদ ফকীহগনের মতে নারীদের জন্য মসজিদে গমন করা মাকরূহ। ঘরে নামায আদায় করা তাদের জন্য উত্তম। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিদের উপর মহিলাদের মসজিদে গমনে নিষেধ করা ওয়াজিব। (সংক্ষেপিত) (সহীহ বুখারী হাদীস, ৮৬৯, মিরকাত, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৮৩৬, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ৫৬৯, ফতোওয়ায়ে আলমগীরি, খন্ড: ১ম, পৃ: ৯৭)