জুম্‌’আর খুতবা

শা’বান মাস ও বরকতময় রজনী শবে বরাতের ফযীলত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৩ মার্চ, ২০২৩ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

আরবি পাঁচটি বর্ণের সমষ্টি শা’বান:

শীন” বর্ণ শরফুন অর্থ মর্যাদা “আঈন” বর্ণ দ্বারা উলুব্বুন অর্থ উচ্চ, উন্নত “বা” বর্ণ বিররুন অর্থ পূণ্য “আলিফ” বর্ণ উলফাতুন অর্থ ভালবাসা অর্থ প্রকাশক, “নুন” বর্ণ দ্বারা নুরুন অর্থ আলো, জ্যোতি, এ মাসের ইবাদত ও নেক আমল দ্বারা বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদা দয়া অনুগ্রহ ভালবাসা কল্যাণ রহমত ও বরকত লাভের সুযোগ অবারিত ও উম্মূক্ত হয়।

এক বর্ণনায় এসেছে শা’বান “শি’বুন থেকে নির্গত অর্থ গিরিপথ, যেমনিভাবে পাহাড় পর্বতে গিরিপথ বা রাস্তা থাকে তেমনিভাবে এ মাস আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের জন্য বান্দার জন্য রাস্তা হয়ে থাকে। (মুকাশাফাতুল কুলুব, পৃ: ৩০০)

এ মাসের নাম করণ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, এ মাস কে শা’বান এ জন্য নামকরণ করা হয়েছে এ মাসে রোজাদার ব্যক্তির জন্য কল্যাণের শাখা প্রশাখা প্রস্ফুটিত হয় যাতে বান্দা জান্নাতবাসী হয়। ( আত্‌তাদভীন ফি আখবারি কাযিহীন, খন্ড: , পৃ: ১৫৩)

শা’বান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

শা’বান মাস বরকত নাযিলের মাস। অধিক পরিমাণ নফল রোজা রাখার মাস, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাস, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর অধিক পরিমাণ দরুদ শরীফ পাঠ করার মাস। এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনায় এতটুকুই যথেষ্ট যে, নবীজি এ মাসকে নিজের মাস বলেছেন, শাবান মাস হলো আমার মাস। (মুসনাদুল ফেরদৌস, খন্ড: , পৃ: ২৭৫, হাদীস নং: ৩২৭৬)

পবিত্র কুরআনের ২২ পারার সূরা আহযাব এর দরুদ শরীফ পাঠ করার নির্দেশ সম্বলিত ৫৬ নং আয়াতে করীমা এ শা’বান মাসেই নাযিল করা হয়েছে। মাওয়া হিব লুদুনিয়া, খন্ড: , পৃ: ৫১৬)

শাবান মাসের রোযা:

শা’বান মাসে বিভিন্ন নেক আমলের মধ্যে নফল রোজা রাখার ফযীলত অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমানিত, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম রোজার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে নবীজি এরশাদ করেছেন, রমজানের সম্মানে শা’বানের রোযা। (তিরমিযী, হাদীস: ৬৬৩)

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট শা’বান মাসের রোজা অন্যান্য মাসের চেয়ে অধিক পচন্দনীয় ছিল। তিনি এ মাসে রোজা রাখতেন। ( আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৩১)

পবিত্র কুরআনের আলোকে লায়লাতুল বরাত:

পবিত্র কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ। আমাদের ধর্মীয় আঙ্গনে প্রচলিত অসংখ্য পরিভাষা রয়েছে ফার্সী, উর্দূ ও বাংলায় ব্যবহার হয়ে আসছে, যেমন নামায, রোজা শব্দ গুলো ফার্সী, এ গুলো কুরআনে পাওয়া যাবেনা এ গুলোর সমার্থক আরবি শব্দ সালাত ও সওম। যেমনিভাবে নামায ও রোজা শব্দদ্বয় কুরআনে না থাকার কারণে নামায রোজা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই তেমনিভাবে শবে বরাত শব্দটিও ফার্সী শব্দ, শব অর্থ রাত, রজনী, বরাত অর্থ মুক্তি, পরিত্রাণ, ভাগ্য। আরবিতে লায়লাতুল বরাত দ্বারা মুক্তির রজনী, ভাগ্যের রজনী বুঝায় পবিত্র কুরআনের সূরা দুখানের “লায়লাতুম মুবারাকা” দ্বারা কতেক তাফসীর কারদের বর্ণনা মতে লায়লাতুল বরাত কে বুঝানো হয়েছে, হাদীসের পরিভাষায় লায়লাতুল বরাতকে “লায়লাতুন নিসফি মিন শাবান” বলা হয়েছে, সুতরাং শবে বরাতের শরয়ী ভিত্তি ও দালিলিক প্রমানাদি অস্বীকার করা বা বিরোধীতা করা উচিৎ নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন, “হামীম সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ আমি সেটাকে বরকতময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী, তাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ বিভাজন করে দেয়া হয়, আমার তরফ থেকে নির্দেশক্রমে নিশ্চয় আমি প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ হতে রহমত, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। (সূরা: দুখান, আয়াত: )

প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ “মিরকাত” এ বর্ণিত আয়াতে “লায়লাতুল মুবারাকা” দ্বারা শাবানের ১৫ তারিখের রজনী বলে মত ব্যক্ত করেছেন, (তুহফাতুল আহওয়াজী, খন্ড: , পৃ: ১৬৭)

লায়লাতুল বরাতের ইসলামী নাম সমূহ:

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (.) বর্ণনা করেন, শবে বরাতের চারটি নাম রয়েছে, . “লায়লাতুল মুবারাকা” বরকতময় রজনী, . “লায়লাতুল বরাত” জাহান্নাম থেকে মুক্তির রজনী, . “লায়লাতুস সাক” “ছাড়পত্র লাভের রজনী, .“লায়লাতুর রহমত” রহমত লাভের রজনী। (আত্‌তিবয়ানু ফি বয়ানি মাফি লাইলাতিন নিসফি মিন শা’বান, খন্ড: , পৃ: ৪১)

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ আলভী মালেকী মক্কী (.) এ মাসের সাথে আরো নাম সংযোজন করেছেন, “লায়লাতুল কিসমত” বণ্টনের রাত, “লায়লাতুল তাকফীর” পাপ মোচনের রজনী, এ রাতে গুনাহগার পাপী বান্দাদের পাপ মোচন করা হয়। “লায়লাতুল ইজাবাহ” দুআ কবুলের রজনী, “লায়লাতুশ শাফায়াত” শাফায়াতের রজনী, “লায়লাতুল জায়িযাহ” পুরস্কার প্রাপ্তির রজনী, “লায়লাতুল গোফরান” ক্ষমা প্রার্থনা ও ক্ষমা প্রাপ্তির রজনী ইত্যাদি (মাযা ফি শাবান, পৃ: ৭১৭৫)

লায়লাতুল বরাত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের বর্ণিত হাদীস:

লায়লাতুল বরাতের রজনী ক্ষমা প্রার্থনার রজনী। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা পাপী বান্দাদের ক্ষমা করার সুসংবাদ অসংখ্য হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নিম্নে কয়েকটি হাদীস শরীফের বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো। হযরত আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনাহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেনে, মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যাতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানু ইবন মাযাহ, হাদীস: ১১৪৪)

শবে বরাত রজনীতে আল্লাহর ঘোষণা:

আমিরুল মু’মিনীন হযরত মওলা আলী, রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যখন শা’বানের মধ্য রাত হবে তখন তোমরা রাত্রি জাগরণ করো ও দিনের বেলায় রোজা রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা সে রাতে সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে তাঁর তজল্লী প্রভা প্রকাশ করেন এবং বলতে থাকেন কেউ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কী? আমি তাকে ক্ষমা করবো। জীবিকা প্রার্থী কেউ আছে কী? আমি তাকে জীবিকা দান করবো। বিপদগ্রস্থ কেউ আছ কী? আমি তাকে বিপদ মুক্ত করে দিব। কেউ আছ কী? কেউ আছ কী? এভাবে রাতের ভোর তথা সূর্যোদয় হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর ঘোষনা আসতে থাকে। (ইবনে মাযাহ শরীফ, খন্ড: , পৃ: ৪৪৪, আততারগীব ওয়াত তারহীব, খন্ড: , পৃ: ১১৯, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২য়, পৃ: ৫১৭)

মু’মিনদের জন্য রাসূলুল্লাহর শাফায়াত শবে বরাতে কবুল হয়েছে:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’আলার দরবারে শাবানের তের তারিখের রাতে উম্মতের জন্য শাফায়াতের প্রার্থনা করেছেন, এক তৃতীয়াংশ উম্মতের জন্য শাফায়াত কুবল করা হলো শাবানের চৌদ্দ তারিখ রজনীতে উম্মতের জন্য শাফাতের দুআ করলেন দুআ তৃতীয়াংশ উম্মতের শাফায়াত কবুল করা হলো। অত:পর পনের শাবান রজনীতে পূনরায় দুআ করা হলো তখন সকল উম্মতের জন্য শাফায়াতের প্রার্থনা কবুল করা হলো। (মুকাশাফাতুল কুলুব, পৃ: ২৫০, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ৫২৩)

শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করা:

হযরত মুআয ইবন জবল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি পাঁচ রজনীতে রাতে জেগে ইবাদত করবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তম্মধ্যে এক রাত হলো ১৫ শাবানের রজনী। (আততারগীব ওয়াত তারহীব, খন্ড: , পৃ: ৯৮, বাহারে শরীফত: খন্ড:৪র্থ, পৃ: ১০৫)

বরাতের রজনীতে কবর যিয়ারতের ফযীলত:

শবে বরাতের রজনীতে পিতা, মাতা মুরাব্বী ও আউলিয়া কেরামের যিয়ারত করা সুন্নত, উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (.) থেকে বর্ণিত, আমি এ রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জান্নাতুল বাক্বী কবরস্থানে পেয়েছি, তিনি মু’মিন নরনারী ও শহীদদের জন্য মাগফিরাত কামনা করছেন। (বায়হাকী)

বরকতময় রজনী সমূহ যেমন শবে বরাতের রজনীতে কবর যিয়ারত করা উত্তম (ফতোওয়ায়ে আলমগীরি)

নুজহাতুল মাজালীস” কিতাবে উল্লেখ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি বরাতের রজনীতে বার রাকাত নফল নামায আদায় করবে প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর এগার বার সূরা ইখলাস পড়বে তার জীবনের গুনাহ আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করবেন।

হে আল্লাহ আমাদের কে বরকতময় রজনী লায়লাতুল বরাতের ফযীলত ও বরকত দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

আবু ছালেহ আনোয়ারী

আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: লায়লাতুল বরাতের রজনীতে মহিলারা কবর যিয়ারতে গমন করা জায়েজ আছে কিনা?

উত্তর: পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত করা সুন্নাত যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তোমরা কবর সমূহের যিয়ারত করো, যেহেতু কবর যিয়ারত মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (সহীহ মুসলিম, খন্ড: , পৃ: ১৩৪), বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ “মিশকাত” এর ব্যাখ্যাকার মোল্লা আলী ক্বারী (.) বর্ণনা করেন, সর্বসম্মত মতানুসারে পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত সুন্নাত। মহিলাদের জন্য মাকরূহ কিনা? এ বিষয়ে দুটি মত রয়েছে অধিকাংশ ওলামাদের মতে মাকরূহ। কতেক আলেমদের মতে ফিতনার আশঙ্কা না হলে মাকরূহ নয়।

আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (.)’র বর্ণনা মতে বিশুদ্ধ মত হলো মহিলারা কবর যিয়ারত গমন জায়েজ নয়। (ফতওয়ায়ে রজভীয়্যাহ, খন্ড:, পৃ: ১৬৫), হাদীস শরীফে মহিলারা কবর যিয়ারত গমন নিষেধ করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের উপর আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। (ইবন মাযাহ, পৃ: ১৯৩)

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলাম আল্লাহর মনোনীত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থার নাম
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে