ইসলামের দৃষ্টিতে চিকিৎসা ও রোগীর সেবা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য, যিনি মানব জীবনকে সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখার জন্য ইসলামী স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার নির্দেশ করেছেন। অসুস্থ ব্যক্তির সেবা ও কল্যাণ কামনায় তাঁর প্রিয় রাসূলের আদর্শ গ্রহণ করার তাগিদ দিয়েছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি একক অদ্বিতীয়, তাঁর কোন অংশীদার নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের সরদার অভিভাবক দোজাহানের কান্ডারী, মুক্তির দিশারী, বিশ্ব মানবতার অগ্রদূত অনুস্মরনীয় আদর্শের মূর্ত প্রতীক, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও প্রিয় রাসূল। তাঁর উপর দরুদ সালাম বর্ষিত হোক। তাঁর আদর্শে উৎসর্গীত, তাঁর পবিত্র বংশধরগণ, আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রতুল্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁর পদাঙ্ক অনুসারী মুমিন নরনারীদের প্রতি অসংখ্য করুণাধারা বর্ষিত হোক।
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ “আল কুরআন” কে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ব শেষ আসমানী কিতাব হিসেবে মেনে চলুন। সুন্দর ও পবিত্র জীবন গঠন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও অসুস্থ রোগীদের সেবা দানে কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত বিধানের আলোকে কল্যাণ ও মানবতার ধর্ম ইসলামের আদর্শ বাস্তায়নে দু:স্থ নিপীড়িত অসুস্থ মানুষের সুস্থতার জন্য মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন।
পবিত্র কুরআনের আলোকে রোগীর শেফা : পবিত্র কুরআনে নিহিত রয়েছে মানব জীবনের সামগ্রিক সমস্যার সামাধান। সকল প্রকার অশান্তি দু:খ যন্ত্রণা ব্যাথা বেদনা দু:চিন্তা হতাশা অস্থিরতা থেকে উত্তরণের সঠিক উপায় ও শেফা রয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করছি যা রোগের শিফা এবং মু’মিনদের জন্য রহমত।” (১৭-সূরা: বনী ইসরাইল: ৮২)
অসুস্থ হলে চিকিৎসা করতে হবে : শারীরিক সুস্থতা আল্লাহর এক মহান নিয়ামত। দৈহিক সুস্থতা সকল সুখের মূল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থতা থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনার অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। অসুস্থ হলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য নবীজির সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম অসুস্থ হলে নবীজির পরামর্শে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমরা কি চিকিৎসা গ্রহণ করব? নবীজি জবাব দিলেন, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর। আল্লাহ তা’আলা একটি মাত্র রোগ ছাড়া সকল রোগের প্রতিষেধক সৃষ্টি করেছেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলে সেটা কোন রোগ যেটার প্রতিষেধক নেই। নবীজি বললেন, তা হলো হারম তথা বার্ধক্য বা মৃত্যৃ। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং: ৮১৮৩১)
চিকিৎসা সঠিক হলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠে : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর রোগ নির্ণয়ে সফল হয়। তাঁর সুচিকিৎসার মাধ্যমে রোগী সুস্থ হয়, অদক্ষ অনবিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসায় রোগীর জীবনাবসান হয়। রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যায়। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “সকল প্রকার রোগের ঔষধ আছে। যখন সঠিক ভাবে রোগের ঔষধ নির্ণয় করা হয় তখন মহান আল্লাহর ইচ্ছায় রোগী আরোগ্য লাভ করে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস:-২২০৪)
রোগীকে সুস্থ হওয়ার জন্য হারাম বস্তু খাওয়ানো যাবেনা : হযরত আবুদ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা রোগ ও ঔষধ দুটিই সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা আছে, সুতরাং তোমরা চিকিৎসা কর, তোমরা হারাম বস্তু দিয়ে চিকিৎসা করো না। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-৩৮৭৪)
রোগীর সেবা করা মুসলমানের হক : মানুষ সামাজিক জীব, সুখে দুখে বিপদে আপদে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগীতা ও সম্প্রীতি রক্ষা করা ইসলামের অন্যতম আদর্শ ও শিক্ষা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বণির্ত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। ১. যখন কোন মুসলমান অসুস্থ হয় তখন তার সেবা করবে।, ২. মৃত্যু বরণ করলে তার জানাযায় উপস্থিত হবে।, ৩. দাওয়াত দিলে কবুল করবে।, ৪. সাক্ষাত হলে সালাম দিবে।, ৫. হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে আয়ারহামুকাল্লাহ বলবে।, ৬. উপস্থিত বা অনুপস্থিত সর্বাস্থায় মুসলমানের কল্যাণ কামনা করবে। (নাসায়ী শরীফ, হাদীস : ১৪৩১)
রোগী দেখা ও তার সেবা করার ফযীলত : অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, তার সেবা যত্ন করা, আথির্ক অসচ্চল হলে তাকে সুচিকিৎসার্থে সাহায্য সহযোগিতা করা, রোগীকে সান্তনা দেয়া, রোগীর সুস্থতার জন্য দুআ করা নবীজির উত্তম শিক্ষা। হযরত সওবান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করবে, সেখান থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত বেহেস্তের ফল আহরণ করতে থাকে। (তিরমিযী, হাদীস: ৯৬৮)
হযরত আবু সাঈদ কুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যখন তোমরা রোগী দেখতে যাবে রোগীর দীর্ঘায়ুর জন্য দুআ করো।” (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ১৪৩৮)
রোগী দেখার সময় রোগীর মাথার পাশে বসা উচিত : নবীজি নিজে রোগী দেখতে যেতেন সাহাবায়ে কেরামকে রোগী দেখা ও সেবা করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রোগী দেখতে যেতেন, তখন তিনি রোগীর শিয়রে বসতেন। (বুখারী শরীফ,হাদীস : ৫৪৬)
নবীজি অসুস্থ ইয়াহুদী খাদেমকে তার ঘরে দেখতে গেলেন : নবীজি অমুসলিম রোগীকে দেখতে ইয়াহুদীর ঘরে তাশরীফ নিয়ে বিশ্ব মানবতার এক নজীর বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইয়াহুদীর ছেলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমত করত, একদা ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়লো, নবীজী তাকে দেখতে গেলেন, নবীজি তার শিয়রে বসলেন এবং তাকে বললেন তুমি ইসলাম গ্রহণ করো, ছেলেটি তার শিয়রে উপবিষ্ট তার পিতার দিকে দৃষ্টি দিলেন তার পিতা তাকে বললো হযরত আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্য করো, তখন ছেলেটি ইসলাম গ্রহণ করলো। তখন নবীজি একথা বলতে বলতে বাইরে আসলেন সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি ছেলেটিকে জাহান্নামের আগুণ হতে রক্ষা করলেন। (আল আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী, হাদীস: ৫২৬)
মুসলমানের রোগ ব্যাধি তার গুনাহের কাফফারা স্বরূপ : মু’মিন মুসলামনগণ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) ও হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুসলিম বান্দার উপর রোগ শোক দুঃখ কষ্ট দুর্ভাবনা যতই আসুক না কেন এমনকি একটি কাটাও যদি তাঁর শরীরে বিদ্ধ হয় তা দ্বারা আল্লাহ তা’আলা তার গুনাহ সমূহ মিটিয়ে দেন। (আল আদাবুল মুফরাদ: ইমাম বুখারী, হাদীস : ৪৯৪)
রোগী দেখতে গেলে নবীজি যে দুআ পড়তেন : সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ আবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন এ দুআ পড়তেন “লা বা-সা তাহুরুন ইনশা আল্লাহ” ( বুখারী শরীফ, হাদীস : ৩৩৪৬)
কোন চিন্তা নেই, আল্লাহ চাহে তো এ রোগ থেকে পবিত্র করবেন। হাদীস শরীফে এ দুআটিও পড়ার উল্লেখ রয়েছে,“আস আলুল্লাহাল আযীমা রাব্বাল আরশিল আযিমী আই ইয়াশফিইয়াকা” (আবুদাউদ শরীফ, হাদীস : ২৭০০)
মহান আরশের প্রভূ মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি তোমাকে রোগমুক্তি দান করুন।
নবীজি রোগীর রোগমুক্তির জন্য যে দুআ করতেন : উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ রোগী দেখতে গেলে তার রোগ মুক্তির জন্য এ দুআ পাঠ করতেন, “ আল্লাহুম্মা রাব্বান নাস, আযহিবিল বাস, ওয়াশফি আন্তাশ শাফী, লা শিফা’ আ ইল্লা শিফাউকা, শিফাআন-লা-ইউগাদিরু সাকামা” “ হে আল্লাহ! হে মানুষের প্রভূ, রোগ ব্যাধি দূর করুন, শিফা দান করুন, তুমিই রোগ থেকে শিফাদানকারী, তোমার শিফা ছাড়া কোন শিফা কার্যকর নয়। এমন শিফা দান করুন যেন এরপর আর কোন রোগ ব্যাধি না থাকে। (বুখারী শরীফ, হাদীস : ৫২৪২)
হে আল্লাহ আমাদেরকে রোগ ব্যাধি থেকে শেফা দান করুন। রোগীদের সেবা করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ ইরফানুল হক
গোমদন্ডী, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: ইমাম ও মুক্তাদির মধ্যে নামাযের রাকাতের সংখ্যা নিয়ে বিরোধ হয়েছে, মুক্তাদি বলছে তিন রাকাত পড়া হয়েছে, ইমাম বলছে চার রাকাত পড়া হয়েছে, এর সামাধান কী?
উত্তর: নামাযের রাকাত সংখ্যা নিয়ে মুক্তাদি ও ইমামের মধ্যে বিরোধ হলে এ ক্ষেত্রে ইমাম চার রাকাত পড়ার ব্যাপারে প্রবল বিশ্বাসী হলে নামায পুনরায় পড়তে হবে না। অন্যথায় পড়তে হবে। আর মুক্তাদির মধ্যে পরস্পর মতবিরোধ হলে তখন ইমাম যে পক্ষে থাকবে তাদের কথা গ্রহণীয় হবে। এক ব্যক্তির বিশ্বাস কম হয়েছে এবং ইমাম ও জামাতের লোকদের সন্দেহ হয়েছে যদি ওয়াক্ত বাকী থাকে পূনরায় পড়ে নেবে। হ্যাঁ যদি দুইজন ন্যায় পরায়ন লোক দৃঢ়তার সাথে বলে তখন সর্বাবস্থায় নামায পূনরায় পড়তে হবে। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ২৪২)