পুণ্যময় রজনী লায়লাতুল কদর
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, কুরআন অবতরণের মাস রমজানুল মুবারকে কুরআনের চর্চা বৃদ্ধি করুন। এ মাসের মহিমান্বিত রজনী লায়লাতুল কদরের ইবাদতে অন্তরাত্মা সিক্ত করুন। মাগফিরাতের শেষ দশকে সকল প্রকার অন্যায় অপরাধ ও পাপাচার থেকে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
আল কুরআনে লায়লাতুল কদরের তাৎপর্য:
রজনী সমূহের মধ্যে পুণ্যময় রজনী লায়লাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। বিশ্বমানব জাতির মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আলকুরআন এ মহিমান্বিত রজনীতে অবতীর্ণ হয়েছে। এ রজনীর তাৎপর্য প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন। আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আমি এটা (কুরআন) “নাযিল করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ রজনীতে ফেরেস্তাগণ ও রূহ (জিবরীল আ:) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে, শান্তি সেই রজনীর উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।” (সূরা: আলকদর)
কদর শব্দের তাৎপর্য:
কদর শব্দ আরবি এর অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহিমা, তাকদীর তথা ভাগ্যলিপি ইত্যাদি, লায়লাতুন অর্থ রজনী, সুতরাং লায়লাতুল কদর অর্থ সম্মানিত ও মহিমান্বিত রজনী। ইমাম যুহরীর মতে কদর রজনী অন্যসব রজনীর তুলনায় অধিক সম্মানের অধিকারী। (কুরতুবি, ২০,১৩০)
কদর এর এক অর্থ নির্ধারণ করা। এ প্রসঙ্গে বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ উমদাতুলকারীতে উল্লেখ হয়েছে, এ রজনীতে বান্দার বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা বিধিমালা ও মর্যাদা নিরূপিত হয়। আল্লাহ তা’আলা এ রজনীতে গোটা বছরের কার্যবিধি ফায়সালা করেন। [উমদাতুলকারী, খন্ড ১১, পৃ: ১২৮, কৃত আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী হানফী (র.)]
কদর রজনীতে ইবাদতকারীর জন্য নবীজির সুসংবাদ:
করুণাময় প্রভূ আল্লাহতা’আলা তাঁর পাপী তাপী বান্দাদেরকে মার্জনার জন্য যে সব পুণ্যময় বরকতময় রজনীসমূহ দান করেছেন লায়লাতুল কদরের রজনী তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রজনী। এ রজনীর ইবাদতের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি লায়লাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় নামায আদায় করবে তাঁর অতীতের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (বুখারী শরীফ, খন্ড ১ম, পৃ: ২৭০, মুসলিম শরীফ)
বেজোড় রজনীতে শবে কদর:
আল্লাহর বান্দাগণ যেন এক রজনীর ইবাদতকে যথেষ্ট মনে না করে, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা প্রাপ্তির আশায় বান্দা যেন বারেবারে আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হয় সে জন্য লায়লাতুল কদরকে নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। রমজানের শেষ দশক মাগফিরাতের দশক। শেষ দশকে নিহিত রয়েছে কদর রজনী, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকে লায়লাতুল কদর তালাশ কর। (সহীহ বুখারী, হাদীস-২০২০)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রজনীতে কদর অন্বেষণ কর। (সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ২০১৬)
তাফসীরকার ও মুজতাহিদ ইমামগণের অভিমত:
কদর রজনীর তারিখ নিধারণ সম্পর্কে প্রায় চল্লিশটি মত রয়েছে। তবে প্রতিবৎসর রমজানের শেষ দশকে লায়লাতুল কদর হওয়াটা প্রমাণিত। এ রজনীর তারিখ নির্ধারিত না করার অন্যতম হিকমত হলো এ রাতের অনুসন্ধানে আল্লাহর বান্দাগণ যেন শেষ দশকে কম পক্ষে পাঁচটি বেজোড় রজনীতে ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকে। (তাফসীর রুহুল মায়ানী, আনোয়ারুল বায়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ৯৫)
২৭ রমজান প্রসঙ্গে অভিমত:
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) শপথ করে বলেছেন, শবে কদর ২৭ রমজান। প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত যরীন (রা.) জিজ্ঞেস করলেন কোন দলীলের ভিত্তিতে আপনি শবে কদর সাতাশ তারিখ বলছেন? তদুত্তরে হযরত ওবাই ইবনে কাব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শবে কদর সম্পর্কে যে লক্ষণ বলেছেন তা এ রাতে পাওয়া যায়। (মিশকাত শরীফ, আনোযারুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ৯৪)
নবীজি আমাদেরকে এর লক্ষণ সম্পর্কে বলেছেন, শবে কদরের পরবর্তী দিবসে সূর্য এমনভাবে উদিত হবে সূর্যের রশ্মিতে প্রখরতা ও তেজ থাকবেনা। (মুসলিম শরীফ)
এ ছাড়াও সে রাতে হালকা ধরনের বৃষ্টিপাত হবে। নবীজি এরশাদ করেছেন, আমি কদরের রজনী পেয়েছি সে রাতে পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করেছি। (বুখারী ও মুসলিম)
শবে কদরে নফল নামায:
নফল ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে ধন্য হয়। আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টি অর্জনের পুণ্যময় আমল নফল ইবাদত। রমজানে প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তদুপরি হাজার মাসের চাইতে শ্রেষ্ঠ রজনী লায়লাতুল কদরের ইবাদতের সওয়াব কত অপরিসীম, আল্লাহ অধিক জ্ঞাত। এ রাতে চার রাকাত, আট রাকাত, বার রাকাত, বিশ রাকাত নফল নামায আদায় করার বর্ণনা বুজুর্গানে দ্বীন ও আউলিয়া কেরামের আমলের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায়। দু রাকাত করে ছয় নিয়্যতে বার রাকাত প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহার সাথে সুরাতুল কদর বা অন্য সূরা সহকারে আদায় করার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। (আনোয়ারুল বায়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ৯৬)
তাহাজ্জুদ নামায, কুরআন তিলাওয়াত, তাওবা এস্তেগফার, যিকর আযকার, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অধিক হারে দরুদ-সালাম পাঠ, পিতা-মাতা, আউলিয়ায়ে কেরাম ও মুরব্বীদের কবর যিয়ারত ও দান-সাদকা এ রজনীর পুণ্যময় আমল।
লায়লাতুল কদরের বিশেষ দুআ:
দুআ ইবাদতের মূল। উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এ রাতে কি দুআ পাঠ করবেন এ সম্পর্কে নবীজিকে জিজ্ঞেস করলে নবীজি এরশাদ করেছেন, তুমি এ দুআ পাঠ করবে, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নী” অর্থ:- হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (সুনানু ইবনে মাযাহ, হাদীস নং: ৩৮৪০, মুসনাদে আহমদ, ইবনে হাম্বল ৬১৭১, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার, পৃ: ৪৮২)
আল্লাহর দরবারে প্রার্থনাই করোনা থেকে মুক্তির উপায়:
আজ গোটা বিশ্ববাসী করোনা মহামারীতে আক্রান্ত, পঁয়ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নত রাষ্ট্রগুলোও আজ সম্পূর্ণরূপে অসহায়। একমাত্র মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা’আলাই বান্দাকে কঠিন ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারেন। মহান আল্লাহর দরবারে সকল প্রকার জঠিল কঠিন রোগ ব্যাধি, অসুস্থতা, দু:খ দুর্দশা বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য তারই নিকট প্রার্থনা করুন। সকাল সন্ধ্যা বিশেষত কদরের রজনীতে আল্লাহর সমীপে দুআ করুন। “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি ওয়াল জুনুনি ওয়াল জুযামী ওয়ামিন সাইয়্যিল আছকামী” হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে শ্বেত রোগ, পাগলামী, কুষ্ঠরোগ ও সর্ব প্রকার খারাপ রোগ ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আগত অনাগত সকল প্রকার বিপদ-আপদের ক্ষেত্রে দুআ অতীব ফলপ্রসু উপকারী। অতএব হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা দুআ করাকে অপরিহার্য কর, গুরুত্বারোপ কর। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং: ২২০৪৪)
রাত জেগে ইবাদত রোগ মুক্তির উপায়:
সুস্থতার জন্য আল্লাহর রহমত দয়া অনুগ্রহ এক বিশেষ নিয়ামত। করোনা মহামারীসহ সকল প্রকার অসুস্থতা থেকে সুস্থতার জন্য কিয়ামুল লায়ল এক বিশেষ উপকারী আমল। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত বিলাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের উপর কিয়ামুল লায়ল আবশ্যক। কেননা এটি তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহীন তথা নেককার বান্দাদের অভ্যাস। রাত জেগে ইবাদতে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। পাপাচার থেকে বিরত রাখে। পাপ সমূহ মোচন করে। শারীরিক অসুস্থতা দূরীভূত করে। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং: ৩৫৪৯)
সকল বিপদাপদ বান্দার কর্মফল:
আল্লাহ পরম করুণাময় দয়ালু তিনি কারো উপর অবিচার করেন না। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমাদেরকে যে আপদ-বিপদ গ্রাস করেছে তা তোমাদের কর্মফল আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই ক্ষমা করেন। (সূরাতুশ শুরা, আয়াত: ৩০)। আমরা প্রতিনিয়ত গুনাহের সমুদ্রে নিমজ্জিত, সকাল সন্ধ্যা দিবারাত্রি দয়াময় প্রভূর প্রতি কতই অকৃতজ্ঞ। অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, মিথ্যাচার, শটতা-কপটতা, সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপরের হক আত্মসাৎ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুুণ্ঠন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, খারাবি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি ইত্যাদি গর্হিত অনৈতিক কাজগুলো আজ মানব জীবনকে সর্বোতভাবে গ্রাস করেছে। তাই আসুন পুণ্যময় কদর রজনীতে মহান প্রভূর সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হই। তাওবা এস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনে শপথ গ্রহণ করি। আসুন দেশকে ভালবাসি, মুসলিম উম্মাহকে ভালবাসি। দেশের মানুষকে ভালবাসি। হে আল্লাহ আমাদের প্রার্থনা কবুল করুন। আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসীলায় মহিমান্বিত রজনীর ওসীলায় করোনা মহামারীর ভয়াবহ অবস্থা থেকে বিশ্ববাসীকে হিফাজত করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
[ইসলাম সম্পর্কিত পাঠকের প্রশ্নাবলি ও নানা জিজ্ঞাসার জবাব দিচ্ছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি। আগ্রহীদের বিভাগের নাম উল্লেখ করে নিচের ইমেলে প্রশ্ন পাঠাতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
Email : azadieditorial@gmail.com]
মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন খান
পাঁচলাইশ, ৩নং ওয়ার্ড, ফকিরাবাদ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: অতি মুনাফা লোভী পণ্য মজুদদার ব্যবসায়ীদের শাস্তি কী?
উত্তর: ইসলামে মজুদদারী হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যারা মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্য ও পণ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখে আল্লাহ তাদেরকে কুষ্ট রোগ ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করেন। (সুনানু ইবনে মাযাহ, পৃ:৩১)
আরো এরশাদ হয়েছে, মজুদদারী অভিশপ্ত। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৮ম খন্ড, পৃ: ২০৪)
ইসলামে মজুদদারীদের নিয়ন্ত্রণে আইনগত ব্যবস্থা জোরদার করার অনুমতি দিয়েছে। এ ধরনের শাস্তিকে তাযীর বলা হয়, যা সরকার ও প্রশাসন কার্যকর করবে। আপরাধের মাত্রা, পরিমাণ ও ধরন অনুপাতে অর্থদণ্ড ও কারাদন্ড উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। বিচারক লঘু থেকে লঘুতর, কঠোর থেকে কঠোরতর যতটুকু শাস্তি উপযুক্ত মনে করবেন প্রয়োগ করবেন। (আল মাবসুত ৯/৩৬, ওয়াল আহকামুস সুলতানিয়া, পৃ: ২২৪, হেদায়া, দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ষষ্ঠদশ খন্ড, পৃ: ৯২)