প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, আল্লাহর কুদরত বিশ্বাস করুন। কুদরত অর্থ শক্তি, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সর্বশক্তিমান।” আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এর পক্ষ থেকে নবুওয়তের সত্যতা প্রমাণের জন্য সংঘটিত খোদা প্রদত্ত অলৌকিক ঘটনাবলী মু’জিযা হিসেবে স্বীকৃত।
কারামত এর সংজ্ঞা: সর্বজন স্বীকৃত ইসলামী আইন ও আকাঈদ বিশেষজ্ঞ আল্লামা সাদ উদ্দিন মাসউদ তাফতাযানী (র.) (৭৯১ হি.) কারামত এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন, কারামত হলো আল্লাহর কোন অলী থেকে প্রকাশিত স্বাভাবিক নিয়মের বিপরীত কোন অলৌকিক ঘটনা যা নবুওয়াতের দাবী ব্যতিরেকে প্রকাশিত হয়। (শরহুল আকায়েদে নসফীয়্যাহ, পৃ: ১৪৫)
কারামাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা আউলিয়ায়ে কেরামের মর্যাদা ও সম্মান দান করেন। এ ক্ষেত্রে অলীর নিজস্ব শক্তি ও ইচ্ছার কোন দখল নেই। মহান আল্লাহই অলীর সত্বায় কারামত সৃষ্টি করেছেন।
আল কুরআনের আলোকে কারামত: অলীদের কারামত সত্য। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতের আলোকে তা প্রমানিত। হযরত মরিয়ম আলাইহিস সালাম মৌসুমবিহীন ফল লাভ করা, এটা তাঁর কারামত ছিলো। হযরত মরিয়ম (আ)’র জন্য ফলফলাদি জান্নাত থেকে আসতো, জান্নাতের ফলফলাদির মাধ্যমে তাঁর প্রতিপালন হতো, মায়ের দুধ বা দুনিয়ার অন্য কোন খাবারের মাধ্যমে নয়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “যখন যাকারিয়া তাঁর নিকট তাঁর নামায পড়ার স্থলে যেতেন তখন তাঁর পাশে খাদ্য সামগ্রী দেখতে পেতেন, তিনি বললেন হে মরিয়ম এ গুলো কোথা থেকে তোমার নিকট এলো? মরিয়ম জবাবে বললেন এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে চান সীমাহীন রিযিকদান করেন। (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ৩৭, তাফসীর নুরুল ইরফান)
উপর্যূক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাছির (র.) বলেন, আয়াত দ্বারা অলীর কারামত সত্য বলে প্রমাণিত হলো, হযরত মরিয়ম (আ) ছিলেন আল্লাহর অলী, তিনি নবী ছিলেন না, কারণ আল্লাহর বিধান মতে কোনো মহিলা নবী হতে পারেনা। পবিত্র কুরআনে ৩৪ বার মরিয়মের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মরিয়ম এর পিতা ইমরান (আ.) ছিলেন হযরত দাউদ (আ.) এর বংশধর, তা ছাড়া তিনি ছিলেন বায়তুল মোকাদ্দাস এর সম্মানিত ইমাম। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল হান্না বিনতে ফাখুজ।
মরিয়ম (আ.)’র হাতের কারামত: আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “এবং খেজুর বৃক্ষের গোড়া ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও তখন তোমার উপর তাজা পাকা খেজুর সমূহ ঝরে পড়বে। (সূরা: মরিয়ম, আয়াত: ২৫)
আল কুরআনের বর্ণিত, আয়াতে মহিলা অলী হযরত মরিয়ম (আ.)’র কারামতের বর্ণনা রয়েছে। হযরত মরিয়াম (আ.) প্রসব বেদনার সময় যেখানে তিনি বসাছিলেন সেখানে দন্ডায়মান খেজুর বৃক্ষের শুস্ককান্ডে নাড়া দেওয়ার জন্য তিনি আদিষ্ট হলেন, নাড়া দেয়া মাত্র তাঁর হাতের স্পর্শের বরকতে খেজুর বৃক্ষের কান্ড মূহুর্তে সজীব সতেজ হয়ে উঠলো, মূহুর্তের মধ্যে খেজুর বৃক্ষে ফল এসে গেল, বৃক্ষ থেকে ফল ঝরে পড়লো এবং তা থেকে তিনি আহার করলেন এ সব কিছু অলীর হাতের বরকতে নসীব হলো, যা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত কারামত হিসেবে স্বীকৃত। প্রখ্যাত বুজুর্গ ও তাফসীরকার হযরত সানাউল্লাহ পানি পথী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, সূরা আল ইমরানে বর্ণিত এ ঘটনা আল্লাহর অলীদের কারামত সত্য হওয়ার অকাট্য দলীল। (তাফসীরে মাজহারী, সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩৭)
হাদীসের আলোকে কারামাতের বর্ণনা: সাহাবাদের মাধ্যমে সংগঠিত ও প্রকাশিত অসংখ্য কারামতের বর্ণনা হাদীস শরীফের আলোকে প্রমানিত। হযরত উমর (রা.) কর্তৃক মদীনা শরীফ থেকে হযরত সারিয়া (রা.) কে আহবান করা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত সারিয়া (রা.) কে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে (ইরাকের) নেহাওয়ান্দ নামক স্থানে পাঠালেন শত্রুর মোকাবিলার সময় হযরত সারিয়া (রা.) পিছনে আত্নগোপনকারী শত্রুপক্ষের আক্রমন সম্পর্কে অপ্রস্তুত ছিলেন, এমতাবস্থায় মদীনা মনোওয়ারায় খুতবা প্রদানকালে আমিরুল মু’নিনীন হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনবার ডাক দিয়ে বলেন, হে সারিয়া! পাহাড়ের দিক থেকে সর্তক হও। তখন এ আহবান শুনে হযরত সারিয়া (রা.) সর্তক হলেন এবং পিছন দিক থেকে শত্রুর উপর আক্রমন করলেন এবং অভিযানে বিজয় অর্জন করলেন। (কানযুল উম্মাল, হাদীস: ৩৫৭৮৩)
বর্ণিত হাদীস শরীফের আলোকে আল্লামা আফীফ উদ্দিন আবদুল্লাহ আসআদ বিন আলী ইয়াফী ইয়ামনী মক্কী (রহ.) (ওফাত ৭৬৮ হি.) দুটি কারামাত উল্লেখ করেছেন। ১. আমিরুল মু’মিনীন মদীনা মনোওয়ারা থেকে ১৪০০ মাইল দুরে অবস্থিত নেহাওয়ান্দ নামক স্থানে মুসলিম সেনাবাহিনীর অবস্থান প্রত্যক্ষ করা। ২. দূরত্বের ব্যাপক ব্যবধান সত্বেও সেনাপতিকে আহবান করা ও সেনাপতি হযরত সারিয়া কর্তৃক আহবান শ্রবণ করে সতর্ক হওয়া। (আর রাওযাতুর রাইয়াহীন, পৃ: ৩৯)
আল্লাহর অলীগণ বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে পারেন: আল্লাহর মকবুল প্রিয় অলীগণ দুর্দশাগ্রস্ত বান্দাদেরকে আল্লাহর হুকুমে সাড়া দিতে পারেন, কুরআন ও হাদীসের আলোকে আউলিয়ায়ে কেরামের খোদা প্রদত্ত মর্যাদা ও ক্ষমতা দালিলিকভাবে প্রমাণিত। হযরত ওবাদা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন আবদাল আছে তাদের দ্বারা জমিন বিদ্যমান থাকবে, তাদের দ্বারা তোমাদের উপর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে, তাদের দ্বারা তোমরা সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে থাকে। (তাবরানী)
নবীজির আযাদ করা গোলাম হযরত সফিনা (রা.) কে জঙ্গলের হিংস্র বাঘ চিনতে পেরেছে: হযরত সফিনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আজাদ করা গোলাম ছিলেন। তিনি একবার রোমে গ্রেফতার হয়েছিলেন। আমিরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারুক (রা.)’র খিলাফত কালে ইসলামী ফৌজ রোমে আগমনের সংবাদ পেয়ে হযরত সফিনা (রা.) রাতের অন্ধকারে জেল কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতসারে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসলেন, রাত অন্ধকার মুসলিম বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে যাতায়াত পথের সুস্পষ্ট ধারণা তাঁর ছিলনা গভীর রজনীতে হঠাৎ বন জঙ্গল থেকে একটা হিংস্র বাঘ বেরিয়ে এলো! হযরত সফিনা (রা.) পশুরাজ হিংস্র প্রাণীকে লক্ষ্য করে বললেন, ওরে বাঘ! তুই কি আমাকে চিনতে পারিস, আমি আল্লাহর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আজাদ করা গোলাম আমি রাস্তা ভুলে দিশেহারা হয়ে পড়েছি, বাঘ এ কথা শুনে, লেজ নাড়তে নাড়তে হযরত সফিনা (রা.)’র সম্মুখ পানে অগ্রসর হয়ে তাঁকে পথের সন্ধান দিয়ে মুসলিম বাহিনীর নিকট পৌছিয়ে দিল, এটা ছিল হযরত সফিনা (রা.)’র কারামত। (মিশকাত, কিতাবুল কারামত)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন। হযরত সাফিনা (রা.) নিজকে নবীজির গোলাম পরিচয় দেওয়ায় বাঘ তাঁকে চিনতে পেরেছে এবং মুসলিম বাহিনীর অবস্থানও জানতে পেরেছিল। প্রতীয়মান হলো প্রাণীরা পর্যন্ত নবীজির গোলামকে জেনে চিনে সম্মান জানাতো। এটা ছিল হযরত সফিনা (রা.)’র কারামত। (শানে হাবীবুর রহমান)
হযরত ইমাম বুখারী (রহ.)’র কারামত: আমিরুল মু’মিনীন ফীল হাদীস হযরত ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ২৫৬ হিজরির শনিবার ঈদুল ফিতরের রাতে এশার নামাযের পর খরতংক নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন। ঈদুল ফিতরের দিন জোহর নামাযের পর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর জানাযার পর কবর মুবারকে শায়িত করার সাথে সাথে বিস্ময়কর অলৌকিক কারামত প্রকাশ ঘটে কবর থেকে মিশক আম্বরের সুগন্ধি বের হতে থাকে। এ কারামত অবলোকনের জন্য বুখারা সমরকন্দ খরতংকসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভক্ত অনুরক্ত মুসলিম জনতার সমাগম পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি তারা সুগন্ধিময় কবরের মাটি সংগ্রহ করে নিতে থাকে এই ঘটনাতে জনসাধারণ আশ্চর্যবোধ করতে থাকে। (ওয়াফায়াতুল আইয়্যন, ২য় খন্ড, পৃ: ৩২৪)
গাউসুল আযম আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র কারামত দেখে কতেক শিয়া তাওবা করলেন: একবার দুষ্ট প্রকৃতির কিছু শিয়া গাউসুল আযম দস্তগীরের কাছে মুখ বন্ধ দুটি ঝুড়ি নিয়ে এসে বললো, বলুন তো এ ঝুড়ি দুটির মধ্যে কী আছে? তিনি একটি ঝুড়ির উপর হাত রেখে বললেন, এতে একজন প্রতিবন্ধী ছেলে রয়েছে। স্বীয় ছাহেবজাদা হযরত সৈয়্যদ আবদুর রাযযাক কে বললেন ঝুড়ির মুখ খোল এবং ভেতরের ছেলেটিকে দাঁড়াতে বল। তিনি ছেলেটিকে দাঁড়াতে বলতেই ছেলেটি দৌড়াতে আরম্ভ করলো অপর ঝু িড়র উপর হাত রেখে বললেন এর ভেতরে একজন সুস্থ ছেলে রয়েছে ঝুড়ির মুখ খুলে তাকে বের হতে নির্দেশ দিলেন ছেলেটি বের হয়ে বসে পড়লো গাউসে পাকের এ কারমত দেখে উপস্থিত শিয়ারা তাওবা করলেন ওই দিন তাঁর মজলিসে এ অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ভয়ে তিনজন লোক মৃত্যুবরণ করে। (নুযহাতুল খাতিরিল ফাতির ফী মানাকিব–ই শায়খ আবদিল কাদির, কৃত: মোল্লা আলী ক্বারী, পৃ: ৪৯)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে আউলিয়ায়ে কেরামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ তৈয়্যবুর রহমান
আন্দরকিল্লাহ, কোতোয়ালী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কলমের ব্যবহার কখন থেকে শুরু হয়েছিল? জানালে কৃতার্থ হব।
প্রশ্নের উত্তর: আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “আল্লাযী আল্লামা বিল ক্বালামী” অর্থ, যিনি কলম দ্বারা লিখন শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা: আলাক্ব, আয়াত: ০৪)
ইলম (জ্ঞান) ও কলম আল্লাহ তা’আলার বড় নিয়ামত, সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ.) গাছের পাতায় লিখেছেন, তাঁর পর হযরত ইদ্রিস (আ.) মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকবার উপর লিখেছেন, তারপর হযরত ইউসূফ (আ.) কাগজের উপর লিখেছেন। হযরত ইউসূফ (আ.) কাগজের প্রথম আবিস্কারক। (রুহুল বয়ান, তাফসীর নূরুল ইরফান, পারা: ৩০, পৃ: ১৬৫৮)
হযরত ইদরিস (আ.) তাঁর যুগে প্রচলিত ৭২টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। হাদীস শরীফে এসেছে, পৃথিবীতে প্রথম কলম ব্যবহার করেছেন, হযরত ইদরিস (আ.)। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উপর নাযিলকৃত বানীসমূহ কলম দিয়ে লিখে রাখতেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩৬২)