প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! মানুষের দায়িত্বের পরিধি ব্যাপক। জীবনের সকল পর্যায়ে সর্বক্ষেত্রে মানুষ আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করবে, ব্যক্তি জীবনে পরিবারে সমাজে ও রাষ্ট্রে মানুষ সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান আল্লাহর উদ্দ্যেশ্য বাস্তবায়ন করবে। মানুষ জমীনে আল্লাহর প্রতিনিধি। সঠিক ভাবে মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মানুষকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান প্রজ্ঞা ও বিবেকবোধ ও সত্য মিথ্যার পার্থক্য করার যোগ্যতা দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
আল কুরআনের আলোকে মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব:
মানব জাতিকে দৈহিক আকৃতি আয়তন দেহের দৈর্ঘ্য প্রস্থ শারীরিক শক্তির বিবেচনায় তাকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ডে উপনীত করা হয়নি তাকে জ্ঞান ও বিবেক “আকল” দ্বারা বৃহত্তর পরিসরে আল্লাহর বিধান কার্যকর ও বাস্তবায়ন করার প্রদত্ত যোগ্যতার কারণে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি। তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দিয়েছি এবং তাদেরকে আবার সৃষ্টির অনেকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। (১৭:৭০)
পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি:
মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর খলিফা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একজন রাষ্ট্রপ্রধান রাজা বাদশাহ দেশে বা বিদেশে তাঁর পক্ষ থেকে বিশেষ দায়িত্ব বা মিশন দিয়ে তাঁর নিযুক্ত প্রতিনিধি প্রেরণ করে থাকেন। মহান আল্লাহ এ পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্টির লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিমিত্তে মানব জাতিকে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মানুষ যখন তাঁর স্রষ্টার মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে পালন করবে তখনি আশরাফুল মাখলুকাত তথা শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় ভূষিত হবে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি তখন ফেরেশতারা বললো আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে সেখানে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে। অথচ আমরা তো আপনার প্রশংসায় পবিত্রতা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ বললেন, নি:সন্দেহে আমি জানি যা তোমরা জানোনা। (সূরা: বাকারা, ২:৩০)। বর্ণিত আয়াতে প্রতীয়মান হলো, মহান আল্লাহ মানব সৃষ্টির সূচনাতে ফেরেস্তাদের মতামত জানতে চাইলে ফেরেস্তারা মানব সৃষ্টির পরবর্তী তাদের নেতিবাচক চরিত্রগুলো উপস্থাপন করা সত্বেও মানব সৃষ্টির গুরুত্ব ও তাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, তাদের সৃষ্টির ফলাফল কি হবে আমিই জানি যা তোমরা জানো না। মানব জাতির মধ্যে যারা আমার লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করবে, ইবাদত বন্দেগী যিকর আযকার তাওবা এস্তেগফার এর পাশাপাশি যারা পৃথিবীতে আমার বিধান কার্যকর করতে নিবেদিত হবে। সর্বাবস্থায় আমার অনুগত থাকবে। সুখে দুঃখ বিপদে সংকটে অভাবে অনটনে কথায় কাজে আচরণে ব্যবহারে সামাজিকতা মানবিকতা দানশীলতা সততা নিষ্ঠা ন্যায় পরায়নতা মহানুভবতা পরস্পর সহমর্মিতা জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমার আদেশ নিষেধ প্রতিপালন ও বাস্তবায়নে যারা অনুগত ও নিবেদিত হবে। তারাই হবে আশরাফুল মাখলুকাত।
হাদীসের আলোকে মানুষের মর্যাদা:
মহান আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টিরাজির মধ্যে মানুষের মর্যাদা সর্বাধিক। মু’মিন বান্দা মহান আল্লাহর নিকট ফেরেস্তার চেয়েও অধিক মর্যাদাবান, পবিত্র কুরআন ও হাদীসে মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে, মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস শরীফ উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছি, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ফেরেস্তাগণ বললেন, হে প্রতিপালক আপনি মানবজাতিকে দুনিয়া দান করেছেন, তারা পানাহার করে, কাপড় পরিধান করে, আর আমরা সর্বদা আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি। আমরা পানাহার করি না, কোনো খেলাধুলা ও বিনোদন করিনা, তাই আপনি যেমনিভাবে মানবজাতিকে দুনিয়া (পার্থিব জীবনের সুখ শান্তি) দান করেছেন, তেমনিভাবে আমাদের জন্য আখিরাত দান করুন। জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলেন, যাদের আমি নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করেছি তাদের সমতুল্য এমন কাউকে করব না। যাদেরকে “কুন” বা “হও” নির্দেশের সাথে সাথে যারা সৃষ্টি হয়েছে তাদেরকে কুদরতী হাতের সৃষ্টির সমতুল্য করব না। (আল মুজামুল আওসাত, ৭ম খন্ড, পৃ: ৯৯)। অর্থাৎ মানব সৃষ্টি ও ফেরেস্তা সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, আল্লাহ মানব জাতিকে নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করে তার দেহে রূহ বা আত্না প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন, ফেরেস্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে “কুন” “হও” নির্দেশ করার পর যারা সৃষ্টি হয়েছে। একজন মানুষের মাঝে মানবীয় সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকার পাশাপাশি যখন তিনি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি পূর্ণ অনুগত্য ও ইসলামী বিধি বিধানের পরিপূর্ণ অনুসরণ করার মধ্যেই মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত।
পৃথিবীর সৃষ্টিরাজি মানব জাতির কল্যাণে সৃজিত: আসমান, জমীন, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়, পর্বত, নদ–নদী, তৃণলতা, বৃক্ষরাজি, জলে ও স্থলে সমুদয় সৃষ্টি রাজি মানুষের কল্যাণে উপকারে ও প্রয়োজনে সৃষ্টি যারা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তিনি সে মহান সত্তা যিনি মানব জাতির কল্যাণে পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। (সূরা: বাকারা, ২:২৯)
জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব: আল্লাহ তা’আলা জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে পৃথিবীর সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে বর্ণনা শৈলী ও ভাষা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। পৃথিবীতে যত প্রকার সৃষ্টি রয়েছে জগতের সকল বস্তুর নাম আল্লাহ হযরত আদম (আ.) কে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন, এরশাদ করেছেন, এবং তিনি আদম কে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন। (সূরা: বাকারা, ২:৩১)। আরো এরশাদ করেছেন, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা: আলাক, ৯৬:৪–৫)।
ফেরেস্তা ও সমুদ্রের মৎসরাজি মানুষের জন্য দুআ করে: পঠন পাঠন শিখন অনুশীলন জ্ঞানার্জন শিক্ষার্জন, শিক্ষার প্রচার প্রসার, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ শিক্ষার কাজে সহযোগিতা, পৃষ্ঠপোষকতা, শিক্ষার বিকাশ ও উন্নয়নে সম্পৃক্ততা ও অবদানের কারনে মানুষের জীবন আলোকিত ও মহিমান্বিত হয়। হযরত আবু উমাম বাহিলী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, হাদীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তাঁর ফেরেস্তাগণ এবং আসমান জমীনের অধিবাসীরা এমনকি গর্তের পিপিলিকা সমুদ্রের মাছ যে ব্যক্তি মানুষকে ইলম (সুশিক্ষা) দিয়ে থাকে তাঁর জন্য দুআ করে। (তিরমিযী, কিতাবুল ইলম ,পৃ: ৩৪)
মানুষের মর্যাদার স্তর: মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য ও ভেদাভেদ নেই। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সকলের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, প্রত্যেকের সম্মান মর্যাদা ও নিরাপত্তা লাভের অধিকার ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত। তবে মর্যাদাগত স্তরে সম্মানিত নবী রাসূলগন সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। নবী রাসূল গণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হলেন মানবতার কান্ডারী মুক্তির দিশারী শাফায়াতের মালিক দোজাহানের সরদার নূর নবী রাহমাতুল্লীল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এরপর সাহাবায়ে কেরাম, এরপর তাবিঈন, এরপর তাবে তাবিঈন এর পর মুজতাহিদ ইমাম গন, আউলিয়ায়ে কেরাম, উলমায়ে কেরাম মু’মিন ও মুত্তাকীগন, মর্যাদার অধিকারী। পার্থিব জীবনে কাফির মুশরিক অমুসলিমরা সম্মানিত ও মর্যাদাবান হলেও মৃত্যু পরবর্তী অনন্তকাল জীবনে কেবল মু’মিন মুত্তাকী পুণ্যার্ত বান্দাগণই সাফল্য সম্মান ও আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা লাভে ধন্য হবেন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ জাকের উল্লাহ চৌধুরী
নিউমার্কেট, কোতোয়ালী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: সাহাবায়ে কেরাম ছাড়া তাবেঈন ও অলী বুজুর্গদের জন্য “রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু” বলা, ব্যবহার করা জায়েজ আছে কিনা?
উত্তর: প্রসিদ্ধ ফতোওয়া গ্রন্থ “দুররে মুহতার” ৫ম খন্ড ৪৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, সাহাবায়ে কেরামের জন্য “রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু” বলা মুস্তাহাব। তাবেঈন তবে তাবেঈন পরবর্তী মুজতাহিদ ইমাম ওলামায়ে কেরাম ও অলী বুজুর্গদের জন্য “রাহমাতুল্লাহি আলায়হি” বলা ও ব্যবহার করা মুস্তাহাব। এর বিপরীত অর্থাৎ সাহাবী ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রেও রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু” ব্যবহার করা জায়েজ আছে (শরহে শিফা কাযী আয়াজ, ৩য় খন্ড, পৃ: ৫০৯)
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (র.) “ফতোওয়ায়ে শামীর” ১ম খন্ডে ছয় স্থানে ইমাম আযম আবু হানিফা কে “রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু” লিখেছেন। এ ভাবে ইমাম শাফেয়ীকে ১ম খন্ডের সাত জায়গায় “রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু” লিখেছেন বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী “ফাতহুল বারী” কিতাবের ভূমিকা ১৮ পৃষ্ঠায় ইমাম বোখারী কে “রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু” লিখেছেন যাঁর জন্ম ১৯৪ হিজরিতে। হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী প্রণীত “আশিআতুল লুমআত” কিতাবে ১ম খন্ড ১৭ পৃষ্ঠায় হযরত গাউসে আযম দস্তগীর আবদুল কাদের জিলানীকে “রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু” লিখেছেন যাঁর জন্ম হয়েছিল ৪৭০ হি. মতান্তরে ৪৭১ হিজরিতে। এভাবে সাহাবায়ে কেরাম ছাড়াও পরবর্তী অলী বুজুর্গ সূফী সাধকদের ক্ষেত্রে রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ব্যবহারের অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। (বিস্তারিত ফতোওয়ায়ে ফয়জুর রাসূল, ২য় খন্ড, পৃ: ৪৯১–৪৯৫)।