জুম্‌’আর খুতবা

ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশনা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২০ জুন, ২০২৫ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী নির্দেশনা মুক্তির পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করুন। নৈতিকতার অবক্ষয়ের এ ক্রান্তিকালে পৃথিবীর সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের মূর্ত প্রতীক আল্লাহর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করুন।

ইসলামের আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ: ইসলাম শব্দটি আরবি “সিলমুন” শব্দমূল থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ আনুগত্য করা, আত্নসমর্পন করা, বশ্যতা স্বীকার করা। (ইবন মানযুর আল ইফরীকী, লিসানুল আরব, খন্ড ৬ষ্ঠ, পৃ: ৩৫৪)

সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী আল হানাফী (.) (মৃ. ৮৫৫ হি.) ইসলামের শরয়ী অর্থ প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মনেপ্রাণে গ্রহণ, কলেমায়ে শাহাদাত মুখে উচ্চারণের মাধ্যমে দ্বীনের আবশ্যিক বিধিবিধান পালন ও ইসলামের নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নামই ইসলাম। (উমদাতুল কারী, খন্ড: , পৃ: ১০৯)

আল কুরআনের আলোকে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশনা: এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, জীবনের সর্বস্তরে শান্তি, সাম্য, শৃংখলা, এক্য ও নিরাপত্তা স্থাপন ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হলো ভ্রাতৃত্ব বোধ। একজন অন্য জনকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখলে পারস্পরিক মমত্ববোধ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা জাগ্রত হয়। হিংসা বিদ্বেষ অনৈক্য ও দূরত্ব বিদূরীত হয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মাজীদে এরশাদ করেছেন, মু’মিনগন পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে। যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। হে মুমিনগন তোমাদের কোন সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে নিয়ে কোনো উপহাস না করে এমনও তো হতে পারে (যাদের উপহাস করা হচ্ছে) তারা উপহাসকারীদের চাইতে উত্তম, নারীরাও যেন অন্য নারীদের উপহাস না করে কারণ যাদের উপহাস করা হয়, হতে পারে তারা উপহাস কারিনীদের চাইতে উত্তম। পরস্পর দোষারোপ করবেনা। পরস্পর মন্দ নামে ডাকবেনা, কারণ ঈমান আনার পর কাউকে মন্দ নামে ডাকা কতই না মন্দ। যারা এ আচরণ থেকে ফিরে না আসবে তারা হবে যালিম। হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কেননা কতক ধারণা পাপের অন্তর্ভূক্ত এবং একে অপরের দোষ অন্বেষনে গোয়েন্দাগিরী করোনা। পরস্পর গীবত করোনা, তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে (অবশ্যই) তোমরা এটা অত্যন্ত ঘৃণা করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়াবান। (সূরা হুযরাত, আয়াত: ১০১২)

মহাগ্রন্থ আলকুরআনের সূরা হুযরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এতে মানব জীবনকে সুন্দর শৃঙ্খলাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য অনেকগুলো তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের জন্য আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের নির্দেশনা: ইসলাম পরিবারে সমাজে রাষ্ট্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব শান্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইসলাম সকলের মাঝে সম্প্রীতি ও পারস্পরিক মমত্ববোধ কর্তব্যবোধের শিক্ষা ও চেতনা জাগ্রত করেছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পর শক্র ছিলে, অত:পর তিনি তোমাদের অন্তরগুলোর মাঝে সম্প্রীতি স্থাপন করেছেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃরূপ লাভ করেছো, তোমরা তো জলন্ত অগ্নিকুন্ডের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে ছিলে, তিনি তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করলেন। (আল ইমরান, আয়াত: ১০৩)

বর্ণিত আয়াতে হিজরতের পূর্বে মদীনার সামাজিক ও রাজনৈতিক করুণ পরিস্থিতি চিত্রিত হয়েছে। যেখানে সুন্দর সুষ্ঠ সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো সাংবিধানিক কাঠামো ছিলনা, অন্যায়, অরাজকতা, বিভেদ বিশৃঙ্খলা ও অশান্ত নৈরাজ্যকর পরিবেশ পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। স্বার্থান্বেষী ইয়াহুদীদের চক্রান্তে মদীনার আওস ও খাযরাজ সম্প্রদায় “বুয়াস” নামে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কয়েক যুগ ধরে লিপ্ত ছিলো। অশান্তির অমানিশায় সমাজ অন্ধকারচ্ছন্ন ছিলো, দেশ ও জাতির এ চরম নাজুক সন্ধিক্ষণে নূর নবীজির পরশে তাঁর ব্যবহারিক জীবনাদর্শ ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে এই দুই সম্প্রদায় নবীজির প্রচারিত ধর্ম পবিত্র আল ইসলামের ছায়া তলে আশ্রিত হয়ে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবিক ও আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠার চেতনায় নতুন জীবন লাভ করে।

মদীনা রাষ্ট্রের গঠন: আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দ্বীনি দাওয়াত ছিল বিশ্বজনীন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র জাতি গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের জন্য তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লীল আলামীন। মদীনায় বসবাসকারী সকল ধর্ম বিশ্বাসীদের সমান অধিকার নিশ্চিত কল্পে জনগণের সম্মতিতে একটি কল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। ইয়াসরিবের জনগন নবীজির শুভ পদার্পনে প্রিয় নগরীর নামকরণ করলেন “মদীনাতুন নবী” অথবা “মদীনাতুর রাসূল”। এ নগরীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদে নববী। এই মসজিদই ছিল ইসলামী শাষন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনার নির্বাহী প্রাণ কেন্দ্র। ইসলামী আইন প্রণয়নের প্রধান কেন্দ্র বিন্দু। রচিত হয় মদীনা সনদ, প্রকৃত প্রস্তাবে মদীনা সনদ ছিলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। মদীনা সনদে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” এবং একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ছাড়া ছিল ৫৩টি অনুচ্ছেদ। মদীনা রাষ্ট্র ছিল ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের। এ সনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যে যার ধর্ম অনুসরণ করবে কিন্তু জাতি হিসেবে সকলে সম্মিলিত ভাবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

হাদীসের আলোকে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের নির্দেশনা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক। বর্তমান বিশ্বে বহুধা বিভক্ত মুসলিম জাতি জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চরমভাবে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, নিগৃহীত, লাঞ্ছিত বঞ্চিত ও অপমানিত। যেখানে ইসলামের শত্রু ইয়াহুদী ও সাম্রাজ্যবাদী তাগুতি অপশক্তির বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলে ইসলামের গৌরব ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব ছিলো সেখানে উল্টো মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মেরুদন্ডহীন শাসক গোষ্ঠী ইহুদী নাসারাদের পদলেহন ও দালালীর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পরস্পর নিজেদের মধ্যে কলহ বিবাদ যুদ্ধ বিগ্রহ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিয়োগিতায় নেমে মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্বকে আজ গভীর ভাবে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। পৃথিবীর মুসলিম রাষ্ট্র গুলোর কোথাও আজ শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন, অতীত গৌরবোজ্জ্বল সোনালী ইতিহাস আজ ক্রমাগতভাবে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম ঐক্য ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি জোরদার করার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রত্যেক মুসলমান পরস্পরের ভাই, সে তার প্রতি অত্যাচার করবেনা, তাকে ব্যর্থ করবেনা এবং ঘৃণা করবেনা। তিনি তাঁর বক্ষের দিকে ইশারা করে তিনবার বললেন, তাকওয়া এখানে। নিজ মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা করা অন্যায়, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের রক্ত সম্পদ ও সম্মান সম্ভ্রম সবই হারাম। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৪)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুসলমান পরস্পরের ভাই। অতএব সে তার ওপর কোনো প্রকার জুলুম করতে পারেনা এবং তাকে অসহায় অবস্থায়ও ফেলতে পারেনা। আর যে তার মুসলমান ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে আল্লাহ তাঁর অভাব পূরণ করবেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৪৪২) তিনি আরো এরশাদ করেছেন, আল্লাহর বান্দাগন! তোমরা পরস্পর পরস্পরের ভাই হয়ে যাও। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৬০৪)। হে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম;

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির

হাশিমপুর বাগিচারহাট, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: পানিতে মৃত মাছ খাওয়া জায়েজ কিনা?

উত্তর: যে মাছ পানিতে মরে ভেসে উঠে, অর্থাৎ কারো কর্তৃক মারা ব্যতিত নিজে নিজে মরে যদি পানির উপর ভেসে উঠে এমন মাছ ভক্ষণ করা হারাম। যদি কেউ মারার ও আঘাতের পর ভেসে উঠে তা ভক্ষণ করা জায়েজ। এভাবে পানির গরমের তীব্রতা বা প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে যদি মাছ মারা যায় অথবা মাছ যদি বড়শীতে বিদ্ধ হয়ে পানিতে মারা যায় বা জালে ফেসে মারা যায় অথবা পানিতে ঔষধ দেওয়ার কারণে মাছ মারা গেল অথবা যদি এমন কোন পাত্রে বা গর্তে মাছ রাখার কারণে মারা যায় যেখানে পানির স্বল্পতা ছিল অথবা স্থানের সংকীর্ণতার কারণে মাছ যদি মারা যায় এমতাবস্থায় মাছ ভক্ষণ করা জায়েজ। (বাহারে শরীয়ত, ১৫তম খন্ড, পৃ: ১০৬, ফতোওয়ায়ে ফয়জুর রসূল, ২য় খন্ড, পৃ: ৪৩৭)

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘বর্ণমালার বর্ণমেলা’ সৈয়দ জিয়াউদ্দীনের সৃষ্টিশীলতার অনবদ্য প্রকাশ
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে বিএনপি