জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে ওয়াকফ সংক্রান্ত নির্দেশনা

ওয়াকফ’র শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ:

ওয়াকফ আরবি শব্দ। এর অর্থ স্থগিত করা, আবদ্ধ করা, নিবৃত্ত রাখা। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়, কোনো সম্পত্তির মালিক নিজের সম্পত্তি নিজের মালিকানা থেকে মুক্ত করে জনকল্যাণ বা জনসেবার বা ধর্মীয় কল্যাণের জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করাকে ওয়াকফ বলা হয়।

ওয়াকফকারী ওয়াকফ করার সময় যা বলবে: ইসলামী শরীয়তে নিম্নরূপ শব্দাবলী উচ্চারণ করলে ওয়াকফ বুঝাবে আমি আমার এই ভূমি আমার জীবদ্দশায় বা ইন্তিকালের পর চিরদিনের জন্য সাদকা করে দিলাম, ওয়াকফ করে দিলাম বললে ওয়াকফ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। (আলমগীরি, ২য় খন্ড)

ইসলামে ওয়াকফের দৃষ্টান্ত: মুসলিম জাতির আর্থ সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওয়াকফ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রি. মদীনায় হিজরতের পর ওয়াকফ সম্পত্তিতে নির্মিত হয় কোবা মসজিদ, মসজিদে নববী শরীফের নির্মাণ ওয়াকফের দ্বিতীয় উদাহরণ। খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামল ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ওয়াকফ কার্যক্রম চালু ছিল। যিনি সম্পত্তি ওয়াকফ করেন তাকে ওয়াকিফ বলা হয়। যে দলিলের মাধ্যমে ওয়াকফ করা হয় তাকে ওয়াকফনামা বলে। ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিকে মুতওয়াল্লি বলা হয়।

আল কুরআনের আলোকে ওয়াকফ: তোমরা যা ভালোবাস তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করবে না। তোমরা যা কিছু ব্যয় কর আল্লাহ অবশ্যই সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত। (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ৯২)

উপরোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাহাবী হযরত আবু তালহা (রা.) বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি আমার প্রিয় খেজুরের বাগান আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওয়াকফ করতে চাই। নবীজি বললেন তোমার এ সম্পদ খুবই মূল্যবান তুমি এ সম্পদ তোমার আত্মীয়দের মাঝে বন্টন করে দাও। তিনি নবীজির নির্দেশ মোতাবেক “বাইরারাহ” বাগানটি আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। ওয়াকফ এর ধারনা ইসলামে স্বীকৃত ও অনুমোদিত।

হাদীস শরীফের আলোকে সম্পত্তি ওয়াকফ করা: হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খায়বারে কিছু জমি লাভ করেন। তিনি এ জমির ব্যাপারে পরামর্শের জন্য রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন এবং বলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি খায়বারে এমন কিছু উৎকৃষ্ট জমি লাভ করেছি। যা এর আগে কখনো পাইনি, আপনি আমাকে এ বিষয়ে কী আদেশ দেন নবীজি বললেন, তুমি ইচ্ছে করলে জমির মূল স্বত্ব ওয়াকফ করতে এবং উৎপন্ন বস্তু সাদকা করতে পারো। বর্ণনাকারী ইবনে ওমর (রা.) এ শর্তে তা সাদকা (ওয়াকফ) করেন যে, তা বিক্রি করা যাবেনা তা দান করা যাবেনা এবং কেউ এর উত্তরাধিকারী হবেনা, ফলে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু উৎপন্ন বস্তু অভাবগ্রস্থ আত্নীয়স্বজন, দাসমুক্তি আল্লাহর রাস্তায় মুসাফির ও মেহমানদের জন্য সাদকা করে দেন, মুতাওয়াল্লী তা থেকে ইনসাফের সাথে ভোগ করতে পারবে। ধনী হওয়ার জন্য নয় (আর সে তা) অন্যদেরকেও খাওয়াতে পারবে। (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ২৫৯৬)

হাদীস শরীফে মানবতার কল্যাণে সাহায্য সহযোগিতা ও দান করার যে নির্দেশনা উৎসাহ অনুপ্রেরণা দেয়া হয়েছে সেখানে ওয়াকফকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তার আমল বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু তিন ধরনের আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে। সাদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম যার দ্বারা কল্যাণ সাধিত হয় এবং সুসন্তান যে তার (পিতা মাতার) জন্য দুআ করে। যেমন মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, কবরস্থান নির্মাণ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, নানাবিধ সেবামূলক জনকল্যাণকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা এসব কাজের স্থায়ীভাবে সওয়াব পেতে থাকবে। ভারতের পার্লমেন্ট ওয়াকফ বিল সংশোধনী পাশ করে সংখ্যালঘু মুসলিম নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে “আল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল বোর্ড” সহ অসংখ্য মুসলিম সংগঠন বিলটির তীব্র বিরোধীতা করে আসছে বিলটির পক্ষে ২৮৮ ভোট পড়েছে বিপক্ষে ২৩২ ভোট পড়েছে। পার্লামেন্টারিয়ানদের বড় একটা অংশই বিলটির বিরোধিতা করেছেন। আল ইন্ডিয়া মজলিস ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের সভাপতি হায়দ্রাবাদের এমপি আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি আইনটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন, ভারত সরকার সংসদের সংখ্যা গরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে মুসলমানদের ধর্মীয় মৌলিক অধিকারকে ছিনিয়ে নিয়েছে যা সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক ও মুসলিম বিরোধী। ভারত সরকার মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তি কুক্ষিগত করার কুমতলবে এ বিল পাশ করেছে। ভারতের পার্লামেন্ট এ চরম বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস করে ভারতীয় মুসলমানদের ওয়াকফকৃত মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, মাজার, কবরস্থান ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে দখলের পথ সুগম করেছে। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবল আপত্তির মধ্যেও লোকসভায় ও রাজ্য সভায় পাশ করা হয়েছে ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫, ২ এপ্রিল বুধবার লোকসভায় এবং ৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় বিলটি অনুমোদন হয়। এ বিল মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর সরকারের দখল দারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি কৌশল। এ বিল পাস হওয়ার পর থেকে ভারতের মুসলমানদের উপর নেমে আসে সরকারি নির্যাতনের ষ্টীম রোলার। মুসলমানদের উপর চলছে প্রতিনিয়ত নির্মম নিষ্ঠুর অমানবিক নির্যাতন। একে একে মসজিদ, মাদরাসাগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সেসব মুসলিম নির্যাতনের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। মুসলমানদের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির স্থাপনের মতো জঘন্য বর্বরোচিত ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটিয়েছে মোদি সরকার, যে কারণে এখনো পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমানদের হৃদয়ে আজো রক্তকরণ হচ্ছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, আর তার চেয়ে অধিক জালিম আর কে হতে পারে। যে আল্লাহর ঘর মসজিদ গুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এ গুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে অথচ ভীত সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের সেগুলোতে প্রবেশ করা সঙ্গত ছিলনা। দুনিয়াতে তাদের জন্য লাঞ্চনা ও পরকালে রয়েছে মহা শাস্তি। (সূরা: আল বাক্বারাহ, আয়াত: ১১৪)

মুসলমানরা আজ একটি কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে একদিকে পরাশক্তি আমেরিকার ইন্ধনে ইহুদীদের কবলে মূসলমানদের পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসে আজ স্বাধীনভাবে বিচরণ ও ইবাদত বন্দেগী করতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে যেমনটি আচরণ করেছিল মক্কার কাফিররা। মক্কাবাসী মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর প্রিয় সাহাবাদেরকে মক্কা থেকে বের হতে বাধ্য করেছিল এমনকি ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদাবিয়ার সন্ধির সময়ও নবীজি আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করার ইচ্ছা পোষন করলে তারা প্রচন্ড বিরোধীতা করে বাধা দেয়। (তাফসীর ইবনু কাছীর, খন্ড:, পৃ: ৩৮৭৩৮৮)

মসজিদ ও মাজার ধ্বংস করে তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছে: মুসলিম জাতির ইবাদতগাহ মসজিদ, মাদরাসা, আল্লাহর প্রিয় নেককার পূণ্যাত্ম বান্দাদের মাজার ও মুসলমানদের কবরস্থান ও স্থাপনাসমূহ যারা ধ্বংস করে বর্বরতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলছে তারা মানবতার শত্রু। মহান আল্লাহ এ শ্রেণির অপকর্মের হোতা যারা অতীত হয়েছে তাদের প্রসঙ্গে বলেন যারা কাফির হয়েছে এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করেছে আমি তাদেরকে আজাবের পর আজাব বাড়িয়ে দেব কারণ তারা অশান্তি সৃষ্টি করত। (সূরা: নাহল, আয়াত: ৮৮)

ওয়াকফ করার শর্তাবলী: . যিনি ওয়াকফ করবেন, তাকে ওয়াকফকৃত সম্পত্তির মালিক হতে হবে। ২. ওয়াকফ কৃত জিনিসের পরিমাণ ও অবস্থান সুনির্দিষ্ট হতে হবে। জমি কতটুকু কোথায় অবস্থিত সুস্পষ্ট না করলে ওয়াকফ সহীহ হবেনা। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি, ২য় খন্ড)

. ওয়াকফের অন্যতম শর্ত হলো স্থাবর সম্পত্তি ওয়াকফ করা তবে অস্থাবর সম্পত্তি ঘোড়া ও যুদ্ধাস্ত্র অস্থাবর হওয়া সত্বেও ওয়াকফ করা যাবে। (আলমগীরি, ২য় খন্ড)

ওয়াকফকারী বালিগ জ্ঞানবান ও বিবেক সম্পন্ন হতে হবে। নাবালিগ ও পাগলের ওয়াকফ সহীহ হবেনা। স্থাবর সম্পত্তি যেমন জমি বাড়ি দোকান ইত্যাদি ওয়াকফ করা জায়েজ। (আলমগীরি, ২য় খন্ড)

মসজিদের জন্য জমি ওয়াকফ করা: মসজিদ নির্মাণ করা ও মসজিদের জন্য জমি ওয়াকফ করা অপরিসীম সওয়াবের কাজ। হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করবেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৫০)

মসজিদের জন্য বাড়ি ঘর ওয়াকফ করা যায়েজ। (আলমগীরি, ২য় খন্ড)

ঈদগাহ মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান, মুসাফিরখানা, যাতায়াতের রাস্তার জন্য জমি ওয়াকফ করা জনসাধারণের পানির সংকট দূরীকরণে কুপ খনন করা, নলকুফ স্থাপন ও জনকল্যাণমূলক কাজের এসব কিছু ওয়াকফ করা জায়েজ ও অধিক সওয়াবের কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় মুসাফিরদের জন্য একখন্ড জমি ওয়াকফ করেছিলেন। (ফতহুল কদীর, ৬ষ্ঠ খন্ড)

ইসলামের তৃতীয় খলিফা আমিরুল মু’মেনীন হযরত উসমান জিন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মদীনাবাসীর পানির কষ্ট দূরীকরণের জন্য “রূমা” নামক একটি কুপ খরিদ করে তা ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। (বুখারী ১ম খন্ড)

ওয়াকফকৃত জমি বিক্রয় করা জায়েজ নেই:

শরীয়ত সম্মত পন্থায় ওয়াকফ করার পর তা কারো মালিকানায় থাকেনা। তা আল্লাহর মালিকানায় চলে যায়। ওয়াকফকৃত সম্পত্তি বিক্রি করা বন্ধক রাখা বা উত্তরাধিকার সূত্রে বন্টন করা কারো জন্যই জায়েজ নেই। (হিদায়া ২য় খন্ড)

মহান আল্লাহ ওয়াকফ সম্পত্তিতে অবৈধ হস্তক্ষেপকারীকে হিদায়ত দান করুন। আমীন।

লেখক : মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅদৃশ্যে প্রশ্ন
পরবর্তী নিবন্ধযে আমলে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন