হে সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করুন। আপনাদের উপর খোদা প্রদত্ত নিয়ামত রাজি ও কল্যাণ সমূহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। ওহে আল্লাহর বান্দাগণ আপনারা অধিকহারে সালাত, সিয়াম ও কিয়াম পালন করুন। ফরজ ও নফলসহ সর্বপ্রকার নামায রোযা কায়মনোবাক্যে আদায় করুন। আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করুন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “ আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে প্রশ্ন করে আমিতো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে আমি তার আহবানে সাড়া দেই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমাতে বিশ্বাস স্থাপন করুক। যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে। (সূরা: বাক্বারা: ১৮৬)
সুপ্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! জেনে রাখুন! রোযা ইসলামের পঞ্চ বুনিয়াদের তৃতীয় স্তম্ভ। রোযার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, ইসলামী শরীয়তের আলোকে ইবাদতের নিয়তে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নাম রোযা। সিয়ামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জীবনকে সর্বপ্রকার অনৈতিক ও অশ্লীল কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকা। সিয়ামের অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য হচ্ছে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের আদেশাবলী পালন করা ও নিষেধাবলী পরিত্যাগ করা। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, “লা আল্লাকুম তাত্তাকুন” যাতে তোমরা তাকওয়া তথা খোদাভীতি অর্জন করতে পার।
হাদীস শরীফের আলোকে শাওয়ালের ছয় রোজার ফযীলত: আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো দিবারাত্রি সকাল–সন্ধ্যা ফরজ ও নফল ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা। এখন আমি আপনাদের সম্মূখে ইসলামে নফল রোযার ফজিলত প্রসঙ্গে আলোচনা ও এতদসংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব।
১. হাদীস শরীফে এরশদ হয়েছে, যে রমজানের রোযা রাখালো, অত:পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখল, সে গুনাহ থেকে এমনিভাবে মুক্ত হয়ে যাবে যেনো আজই মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হলো। (মাযমাউয যাওয়ায়িদ, ৩য় খন্ড, হাদীস ৫১০২)
২. যে ব্যক্তি শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখলো সে যেনো সারা বছর রোযা রাখলো, কেননা যে একটা নেকী করবে সে দশটি সওয়াব পাবে। রমজান মাসের রোযা দশমাসের সমান ছয়দিন দুই মাসের সমান, সুতরাং বার মাসের রোযা হয়ে গেলো। (আসসুনানুল কুবরা লিন নাসায়ী, ২য় খন্ড, হাদীস নং: ২৮৬০,২৮৬১)
গরমের দিনের রোযার ফযীলত: হযরত ইমাম কাতাদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ওস্তাদ হযরত ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে গালিব হাদ্দানী কে শহীদ করে দেয়া হলো, দাফনের পর তাঁর কবর শরীফ থেকে মিশকের সুগন্ধি বের হলো। স্বপ্নে কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, পরকালে আপনার সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়েছে? উত্তর দিলেন খুব ভাল আচরণ করা হয়েছে, জিজ্ঞেস করা হলো আপনাকে কোথায় নেয়া হলো, বললেন জান্নাতে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলের কারণে আপনার এ মর্যাদা নসীব হলো, উত্তর দিলেন কামিল ঈমান, তাহাজ্জুদ নামায ও প্রচন্ড গরমের দিনে রোযা রাখার কারণে এ ফযীলত অর্জন হয়েছে। (হিলইয়াতুল আউলিয়া, খন্ড: ৬ষ্ঠ, পৃ: ২৬৬)
মাসআলা: ছয় রোযার জন্য কোন দিন নির্দ্দিষ্ট করা নেই। মাসের যে কোন সময় রাখা জায়েজ। উত্তম হলো ছয় রোযা পৃথকভাবে রাখবে। ঈদের পর লাগাতার ছয়দিন এক সাথে রাখলেও কোন ক্ষতি নেই। (বাহারে শরীয়ত)
মাসআলা: শ্রমিক বা কর্মচারী নফল রোযা রাখার কারণে কাজ যদি পূর্ণভাবে করতে না পারে সে ক্ষেত্রে রোযা রাখার ব্যাপারে মালিকের অনুমতি নিতে হবে।
আর যদি রোযা রেখে কাজ পূর্ণরূপে করতে পারে সেক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৭)
মাসআলা: নফল রোযা শুরু করার দ্বারা আবশ্যক হয়ে যায়। যদি ভঙ্গ করে কাযা দেওয়া ওয়াজিব হবে। (দুররুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৬৬)
মাসআলা: মাতা–পিতা যদি নিজ সন্তান–সন্ততি কে রোগ ব্যাধির ভয়ের কারনে নফল রোযা রাখতে নিষেধ করে সেক্ষেত্রে মাতা–পিতার কথা মেনে নিবে। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত)
রমজানের পর মহররম মাসের রোযা উত্তম রোযা : হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজান মাসের পর সর্বোত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মহররম মাসের রোযা। ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হলো রাতের নামায তথা তাহাজ্জুদের নামায। (মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড, পৃ: ৩৮৮, হাদীস নং ১১৬৩)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা যখন আশুরার রোযা রাখেন এবং রাখার আদেশ করেন, সাহাবারা বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ এটা এমন একটি দিন যেদিনকে ইয়াহুদী, খৃস্টানরা সম্মান করে তদুত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন আমি যদি আগামী বছর বেচে থাকি নবম তারিখও রোযা রাখবো। (মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড, হাদীস নং ১১৩৪)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি এরশাদ করেছেন তোমরা নবম ও দশম তারিখে রোযা পালন করো এবং ইয়াহুদীদের বিপরীত করো। (তিরমিযী শরীফ ১ম খন্ড, হাদীস নং ৭৫৫)
সোমবার দিবসে রোযা পালন: সোমবার দিবসের গুরুত্ব বর্ণনায় এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এরশাদ করেছেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার দিবসে জন্ম গ্রহণ করেন, সোমবারে নবুয়ত লাভ করেন, সোমবারে ওফাত বরণ করেন। সোমবারে মক্কা থেকে মদীনার পথে হিজরত করেন, সোমবার মদীনায় পৌছেন, সোমবারে হাজরে আসওয়াদ উত্তোলন করেন। (মুসনাদে আহমদ ৪/১৭২, হাদীস নং ২৫০৬)
হযরত কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবার দিবসে রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তদুত্তরে নবীজি বললেন, এদিনেই আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এদিনে নবুওয়ত পেয়েছি, এদিনে আমার উপর কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ হয়েছে। (সহীহ মুসলিম শরীফ, ২/৮১৯)
প্রতি মাসে আইয়্যামুল বীযের তিনটি রোযা পালন: প্রতি চন্দ্র মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখকে আরবিতে আইয়্যামুল বীয বলা হয়। বীয শব্দের অর্থ উজ্জ্বলতা চন্দ্র মাসের এতিন রাতে চাঁদের আলো অধিক উজ্জ্বল হওয়ায় একে আইয়্যামুল বীয বলা হয়। নবীজি প্রতি চান্দ মাসের এ তিন দিনে রোযা পালন করতেন। হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাসের তিনটি উজ্জ্বলতম দিন তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখ সওম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান খন্ড ৮, হাদীস নং ৩৬৫৬)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে কিংবা ইকামাতে কখনোই আইয়্যামুল বীযের রোযা ছাড়তেন না। ( আল মু’জামুল কবীর, খন্ড ১২, হাদীস নং ১২৩২০)
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোযা রেখে শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখবে এটা তার পূর্ণ বছরের রোযার সমতুল্য হবে। (মুসলিম শরীফ, ১ম খন্ড, হাদীস নং ১১৬৪)
দাউদ (আ:)’এর রোযা উত্তম নফল রোযা: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এরশাদ করেছেন, আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় রোযা হলো দাউদ (আ🙂 এর রোযা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন, একদিন ইফতার করতেন (অর্থাৎ একদিন অন্তর অন্তর রোযা রাখতেন) আর আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় নামায হচ্ছে দাউদ (আ🙂 এর নামায, তিনি রাতের অর্ধেক নিদ্রা যেতেন এক তৃতীয়াংশ সালাত আদায় করতেন, আবার এক ষষ্ঠমাংশ ঘুমাতেন। (বোখারী শরীফ খন্ড ৩, হাদীস নং ৩২৩৮)
হে আল্লাহ আমাদের সালাত, সিয়াম, কিয়াম কবুল করুন। যেমনিভাবে আপনার মকবুল বান্দাদের কবুল করেছেন, আল্লাহ আমাদের আপনাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন। পবিত্র কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা আমাদের নাজাত দান করুন। আমি বিতাড়িত শয়তানের অনিষ্ঠতা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআন মজীদে এরশাদ করেছেন “যদি কেহ স্বত:স্ফুর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে তবে বুঝতে যে সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মহান দানশীল, রাজাধিরাজ, পুণ্যবান অতি দয়ালু মেহেরবান। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম;
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।.